গ্যালারিতে ‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ’ চিৎকার নেই। স্টেডিয়ামজুড়ে নেই বর্ণিল আলোকসজ্জাও। তবে আছে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা ‘ফ্লাডলাইটের আলো’ আর দেশজুড়ে ছুটির আমেজ। শুক্রবার এমনিতেই সরকারি ছুটির দিন। তার ওপর চলছে ‘কঠোর বিধিনিষেধ’। চারদিকে অস্বস্তির খবরের তো আর শেষ নেই। এমন দিনে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে প্রথমবার সিরিজ জয়ের খবর পাওয়া গেলে দারুণ হতো ব্যাপারটা। হলো তো সেটাই। তাতে গড়া হয়েছে আপাতদৃষ্টিতে ‘উৎসবহীন’ এক ইতিহাস।
দেশের ক্রিকেটে ‘স্বর্ণের অক্ষরে লেখা দিন’ চাইলে হাতে গুণে গুণে বলে দেওয়া যায়। তাতে ৬ আগস্ট অর্থাৎ আজকের দিনটি লিখে রাখাই যায়। অস্ট্রেলিয়াকে টানা তিন ম্যাচ হারিয়ে বাংলাদেশ পাঁচ ম্যাচের সিরিজটা নিজেদের করে নিয়েছে। ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে প্রতাপশালী দলের একটির বিরুদ্ধে এই প্রথম এমন কীর্তি!
সিরিজ জয়ের ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশ পায় ১২৭ রানের পুঁজি। জবাবে অজিরা তুলতে পারল ১১৭ রান। তাতে ১০ রানের জয় পেয়ে যায় বাংলাদেশ। আর এই জয়ের মাধ্যমে অজিদের বিপক্ষে যেকোনো ফরম্যাটে ঐতিহাসিক সিরিজ জয়টাও ধরা দিল টাইগারদের হাতে। টানা তিন ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর ঘটনাও এই প্রথম।
বিকেল হতেই শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি। অভিমানী মেঘ শঙ্কা জাগায় আদৌ হবে কি না ম্যাচ। বাংলাদেশের উৎসবের দিনের অপেক্ষা কি ভাসিয়ে নিয়ে যাবে বৃষ্টি? শঙ্কা জাগে এমনও। সেটা অবশ্য শেষ অবধি হয় না। কত কত দিনের অপেক্ষা ছিল এমন কিছুর, সেটা যদি বৃষ্টি ভাসিয়ে নেয় তাহলে কী করে হবে!
শেষ অবধি ম্যাচ শুরু হয় সোয়া এক ঘণ্টা পিছিয়ে। টস হয়। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ সেটি জিতেন আট ম্যাচ পর। কিন্তু শুরুতেই শুরু হয় পুরোনো অস্বস্তি। ওপেনারদের ফর্ম ভাবনায় ছিল শুরু থেকেই। তারা পারেননি এদিনও।
দুই ওপেনারের বিদায়ে অবশ্য দ্রুতই কাটিয়ে ফেলেন দুই অভিজ্ঞ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও সাকিব আল হাসান। তাদের ৪৪ রানের জুটি ভালো কিছুর বার্তাই দেয়। সাকিব ১৭ বলে ২৬ রান করে ফেরেন সাজঘরে। ভরসা হয়ে থেকে যান মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।
তিনি টিকে ছিলেন ইনিংসের শেষ ওভার পর্যন্ত। প্রথম ইনিংসের পর তার ইনিংস নিয়ে ‘প্রশ্ন’ থাকতে পারে হয়তো। ম্যাচশেষে নিশ্চয়ই আর নেই। ৫৩ বলে ৫২ রানের ইনিংসটির গুরুত্বের কথা ম্যাচজয়ের পর বুঝতে পারার কথা।
গুরুত্ব অবশ্য ছিল দুইটি ছোট্ট ইনিংসেরও। দুটিই শেষ হয়েছে রান আউটে। ৫ বলে ১১ করা নুরুল হাসান সোহান আর ১৩ বলে ১৯ রান করা আফিফ হোসেন দুজনই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন বাংলাদেশের ১২৭ রানের সংগ্রহে।
বৃষ্টি হলেও উইকেটে যে টিকে থাকলে মারা যাবে সেটা বুঝিয়ে গিয়েছিলেন সাকিব-আফিফ-সোহানরা। তাতে পুঁজিটা কম হয়ে গেল কি না এমন শঙ্কা ছিলই। ৫ বলে ১ রান করে নাসুম আহমেদের বলে ক্যাচ দিয়ে ম্যাথু ওয়েড শরিফুলের হাতে ক্যাচ দিয়ে আগের দুই ম্যাচের ‘রোগ’ যে সারেনি, এমন বার্তাই হয়তো দিয়েছিলেন।
কিন্তু খানিক বাদেই সেটাকে ‘ভুল’ প্রমাণ করতে যেন নিজেদের সবটুকু দিয়ে দেন ম্যাকডারমট ও মিচেল মার্শ। দুজনের অপরাজিত ৬৩ রান ভয় ধরাচ্ছিল আজ হয়তো উৎসবটা হবে না। সেটা আরও বাড়ায় শরিফুলের ক্যাচ মিস।
উইকেট যখন একদম জরুরি হয়ে গেছে। তখন অধিনায়ক বোলিংয়ে নিয়ে আসেন মুস্তাফিজকে। বিপদে তো তিনিই ভরসা। তা মুস্তাফিজও বুঝতে পেরেছিলেন। ম্যাকডারমট ক্যাচ তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তার বলে। কিন্তু শরিফুল এমন লোপ্পা ক্যাচটা ফেললেন। যেটা দশবার তার কাছে আসলে অন্তত নয়বারই ধরার কথা।
ওই ক্ষতে অবশ্য আর বাড়তি ঘাঁ লাগেনি। সেটা সাকিবের কারণে। ম্যাকডারমটকে বোল্ড করে সাজঘরের পথ দেখিয়ে মার্শের সঙ্গে তার জুটিটা তো ভেঙেছেন তিনিই। বাকি কৃতিত্বটা মুস্তাফিজুর রহমানকে একা দিয়ে দিলেও খুব বড় ‘অন্যায়’ হওয়ার কথা না।
১৯ তম ওভারে এসে তিনি পাঁচটি ডট বল করেছেন, কেবল দিয়েছেন এক রান। এই একটি তথ্যই তো মুস্তাফিজের মাহাত্ম্য বুঝানোর জন্য যথেষ্ট। সবমিলিয়ে শুক্রবার দিনটি ‘স্বর্ণের অক্ষরে লেখা দিন’ই হয়ে থাকল।
এমন সিরিজ জয় আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিশ্চয়ই দলকে বাড়তি অনুপ্রেরণা দেবেই। অস্ট্রেলিয়াকে তো আর রোজ রোজ সিরিজ হারানো যায় না। তা সেটা নিজেদের মাঠ হোক, প্রতিপক্ষের ‘এ’ বা ‘বি’ দল যাই হোক।
তবে সব অঙ্ক কষা এখন এক পাশে সরিয়ে উৎসবে মাতা যায়। সেটা বাংলাদেশের ড্রেসিং রুম হোক কিংবা দেশজুড়ে বন্দি থাকা প্রতিটা ‘ঘরে’। শত হোক, ক্রিকেট এখনো ওই অল্প জায়গার একটি; যেখানে এসে সবাই এক হয়ে যান। আজ নিশ্চয়ই তা আরও একবার হবে।