আত্মত্যাগের আরেক নাম ড. জোহা
logo
ঢাকা, শনিবার, ৩০শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আত্মত্যাগের আরেক নাম ড. জোহা

রাজিয়া সুলতানা, রাজশাহী বিশ্ববিদালয়
ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২২ ১২:০৫ অপরাহ্ণ
Link Copied!

আজ ১৮ ফেব্রুয়ারি। আত্মত্যাগের এক অনন্য দৃষ্টান্তের দিন। দৃষ্টান্তের মহানায়ক শহীদ ড. শামসুজ্জোহা। জোহা শুধুই একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস । জোহা কোনো অঞ্চলের ইতিহাস নয়, তিনি হলেন পুরো বাংলাদেশের ইতিহাস। তার আত্মত্যাগকে সারা বাংলাদেশের মানুষ স্মরণ করবে এটিই অনুমিত। কিন্তু সেই ইতিহাস কেবলই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে।

ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি একজন শিক্ষকের কতটুকু দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ থাকা উচিত, ড. শামসুজ্জোহা জীবন দিয়ে সেটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে যেন আমার গায়ে গুলি লাগে।’ যিনি আজকের এই দিনে নিজের জীবন দিয়ে বাঁচিয়ে ছিলেন হাজারো ছাত্রছাত্রীর জীবন।

ড. শামসুজ্জোহা স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীনতার। তাই তো তিনি শিক্ষার্থীদের মাঝে স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধারণ করতে শেখাতেন। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও অভিভাবকসুলভ আচরণ শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার মাঝেই তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। ড. জোহার নামটি স্মরণ করতে হয় স্বাধীনতার আন্দোলনের শুরুর প্রেক্ষাপট থেকে। দেশ ভাগের পর থেকেই পাকিস্তান সরকার এদেশের অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবী, লেখক, গবেষক, সাংবাদিক সবার কণ্ঠকেই দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে।

সময় তখন ১৯৬৬, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু ৬ দফায় বাঙালির স্বাধীনতার বীজ বপিত ছিল সেটি বাঙালি জাতি অনুধাবন করেছিলো। ফলে দেশব্যাপী ৬ দফা বাস্তবায়নের ব্যপক আন্দেলন শুরু হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে।

১৯৬৬-১৯৬৮, তত দিনে বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে।
পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করলে ৬ ও ১১ দফার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলায় গণ-আন্দোলন শুরু হয়। এমন একটি আবহে ড. জোহা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৬৯ সালের ১৯ জানুয়ারি ছাত্রনেতা আসাদ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হক নিহত হলে তাঁদের হত্যার প্রতিবাদ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে গণ-অভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়। একই দাবিতে ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়ে ওঠে এবং ধর্মঘট পালিত হয়। একইদিন স্থানীয় জেলা প্রশাসন রাজশাহী শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সব ধরনের মিছিল-মিটিং নিষিদ্ধ করে।

ওইদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মুক্তিকামী জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করেন। মিছিলটি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ অধ্যক্ষের বাসভবনের সামনে পৌঁছলে পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকসহ মুক্তিকামী জনতার সংঘর্ষ বাধে।

সংঘর্ষে অনেকে আহত হন, অনেকেই হন কারাবন্দি। ওই ঘটনা শোনামাত্র ড. শামসুজ্জোহা দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যান এবং আহত মুক্তিকামী জনতাকে নিয়ে হাসপাতালে যান। এ ঘটনার পরদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে চরম উত্তেজনা।

বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তুতি নেন। অপরদিকে সশস্ত্র বাহিনীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটে প্রস্তুত রাখাসহ মেইন গেট তালাবদ্ধ করে রাখে পাকিস্তানি ক্ষমতাসীনরা। উদ্দেশ্য যেন ছাত্র-জনতা বের হতে না পারেন।

এরপর আন্দোলনরত বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা সব প্রতিরোধ ও বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে মেইন গেটের সীমানা প্রাচীর টপকে বের হওয়া শুরু করলে শিক্ষকরা মেইন গেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রহরীকে গেট খুলে দেয়ার নির্দেশ দেন।

এমন সংকটময় মুহূর্তে মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে সামরিক জান্তার দোসররা রাইফেল উঁচিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকলে ছাত্ররা পাকবাহিনীর পার্ক করা একটি গাড়িতে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ড. জোহা পাকসেনা অফিসার ক্যাপ্টেন হাদির সঙ্গে কথা বলার জন্য এগিয়ে যান এবং তাকে অনুরোধ করেন যেন সেনাবাহিনীর তরফ থেকে কোনো অ্যাকশনে না যায়। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘প্লিজ, ডোন্ট ফায়ার। আমার ছাত্ররা এখনই ক্যাম্পাসে ফিরে যাবে।’

কিন্তু পাক হায়েনারা সেদিন ড. জোহার সে অনুরোধে কর্ণপাত করেনি। কিছুক্ষণ পরই অতি নিকট থেকে তাদের রাইফেলের ছোড়া গুলি জোহার পেট দিয়ে ঢুকে পিঠের দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মৃত্য না ঘটায় তাকে বেয়নেট চার্জ করে ক্ষতবিক্ষত করা হয়।

পরে তাকে ভ্যানে করে দ্রুত শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেদিন পথে পথে ব্যারিকেড থাকায় তাকে হাসপাতালে নিতে বেলা গড়িয়ে যায়। দীর্ঘ সময় পর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়, ততক্ষণে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়, যার ফলে ডা. দত্ত অনেক চেষ্টা করেও ড. জোহাকে বাঁচাতে পারেননি।

মহান এই শিক্ষক ১৯৩৪ সালের ১ মে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন এবং শিক্ষাজীবনের সব ক্ষেত্রেই সফলতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তিনি ১৯৪৮ সালে প্রথম শ্রেণিতে ম্যাট্রিকুলেশন ও ১৯৫০ সালে প্রথম শ্রেণিতে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পরবর্তী সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬১ সালে ড. শামসুজ্জোহা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন এবং পরের বছরেই তিনি উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে লন্ডনের বিখ্যাত ইমপেরিয়াল কলেজে যান। তিনি ১৯৬৪ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন এবং ১৯৬৬ সালে রিডার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। পরবর্তীতে উনসত্তরের সাহসিক আত্মত্যাগ তাঁর সংগ্রামী বিবেক এবং শিক্ষকসুলভ দায়িত্ববোধেরই পরিচয় দেয়।

দৈনিক বিবর্তন এর প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।