আমরা পানি পান করলে তা কিডনির মাধ্যমে ছেঁকে মূত্রনালিতে পৌঁছায় এবং মূত্র হিসেবে বের হয়ে যায়। মানবদেহের দুটি কিডনি, দুটি ইউরেটার, একটি ইউরিনারি ব্লাডার (মূত্রথলি) এবং ইউরেথ্রা (মূত্রনালি) নিয়ে মূত্রতন্ত্র গঠিত।
এই রেচনতন্ত্রের যেকোনো অংশে যদি জীবাণুর সংক্রমণ হয়, তবে তাকে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বলা হয়। কিডনি, মূত্রনালি, মূত্রথলি বা একাধিক অংশে একসঙ্গে এই ইনফেকশন হতে পারে। একে সংক্ষেপে ইউরিন ইনফেকশন বলা হয়।
নারী-পুরুষ উভয়েরই ইউরিন ইনফেকশন হতে পারে। তবে নারীরা তুলনামূলক বেশি এই সমস্যায় আক্রান্ত হন। বর্ষায় ইউরিন ইনফেকশনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এই রোগটি সম্পর্কে চলুন বিস্তারিত জেনে নিই-
ইউরিন ইনফেকশন কেন হয়?
রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি থাকলে ইউরিন ইনফেকশনের আশঙ্কা থাকে। ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের মূল কারণ ‘ই কোলাই ব্যাকটেরিয়া’। আমাদের অন্ত্রেই এই ব্যাকটেরিয়া থাকে। ইউরিনারি ট্র্যাক্টের মাধ্যমে এই ব্যাকটেরিয়া শরীরে প্রবেশ করলেই সমস্যা দেখা দেয়।
ইউরিন ইনফেকশনের জন্য নারীদের গোপনাঙ্গের গঠনও কিছু দায়ী। যেহেতু এর গঠন উন্মুক্ত, তাই কর্মক্ষেত্র, শপিং মলে কমন টয়লেট ব্যবহারে সমস্যায় পড়তে হয়। এছাড়াও পিরিয়ডের সমস্যা, নিয়মিতভাবে হরমোনের ওষুধ খাওয়া ইত্যাদি কারণে ইউরিন ইনফেকশন হয়।
নারীদের মূত্রদ্বারের কাছেই থাকে মলদ্বার। এই কারণেও কিন্তু ইনফেকশনের সমস্যা অনেক বেশি হয়। অনেকসময় যৌনতা থেকেও হতে পারে ইউরিন ইনফেকশন।
ইউরিন ইনফেকশনের কারণ
নানা কারণে এই সংক্রমণ হতে পারে। এর সম্ভাব্য কিছু কারণ হলো-
পানি কম পান করা
প্রস্রাব বেশিক্ষণ চেপে রাখা
প্রতিদিন ঠিকমতো গোসল করা না করা
গোপনাঙ্গ পরিষ্কার না করা
খুব আঁটসাঁট অন্তর্বাস পরা
পোশাক ধোয়ার সময় সাবান লেগে থাকা ইত্যাদি
ইউরিন ইনফেকশনের লক্ষণ
প্রস্রাবে দুর্গন্ধ হওয়া
প্রস্রাব গাঢ় হলুদ বা লালচে হয়ে যাওয়া
প্রস্রাব করার সময় জ্বালা বা ব্যথা অনুভব করা
একটু পর পর প্রস্রাবের বেগ অনুভব করলেও ঠিকমতো প্রস্রাব না হওয়া
তলপেটে বা পিঠের নিচের দিকে তীব্র ব্যথা করা
বমি ভাব বা বমি হওয়া
সারাক্ষণ জ্বর জ্বর ভাব বা কাঁপুনি দিয়ে ঘন ঘন জ্বর আসা ইত্যাদি
ইউরিন ইনফেকশন হলে কী করা উচিত
পানি কম পান করার কারণে সবচেয়ে বেশি ইউরিন ইনফেকশন হয়ে থাকে। তাই প্রচুর পানি পান করতে হবে। দিনে অন্তত আড়াই থেকে তিন লিটার পানি পানের অভ্যাস করুন। বিশেষ করে প্রস্রাবে হলুদ ভাব দেখা গেলেই দ্রুত প্রচুর পানি পান করুন।
যাবতীয় রোগের উৎস এই ইনফেকশন। তাই গোসলের সময় অবশ্যই গোপনাঙ্গ পরিষ্কার করুন। তবে নারীদের গোপনাঙ্গের অভ্যন্তরে ভুলেও সাবান ব্যবহার করা যাবে না। অন্তর্বাস ভালো করে ধুয়ে ব্যবহার করুন। আঁটসাঁট ও সিল্কের অন্তর্বাস পরিহার করুন। বাথরুম যেন পরিষ্কার থাকে সেদিকে খেয়াল রাখুন। পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করার আগে স্প্রে করে বসুন।
ইউরিন ইনফেকশন থেকে বাঁচতে খাদ্যতালিকায় নজর দিন। কফি, অ্যালকোহল ও ক্যাফেইনযুক্ত খাবার খাওয়া বাদ দিতে হবে। এসব পানীয় মূত্রাশয়ে সংক্রমণ বাড়াতে পারে। চিনিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন। কারণ রক্তে চিনির পরিমাণ বেশি থাকলে তা ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়ায়। মসলাদার খাবার কম খাওয়ার চেষ্টা করুন।
পানির পাশাপাশি ইউরিন ইনফেকশন হলে দই খান। এতে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়া মূত্রাশয়ের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে দূর করতে ভূমিকা রাখে। ক্র্যানবেরি নামের একটি গুল্ম আছে। এর জুসে প্রচুর ফাইটোক্যামিকেল থাকে যা শরীর থেকে ই কোলাই ব্যাকটেরিয়া বাইরে পাঠিয়ে দিতে সহায়তা করে। ক্র্যানবেরি জুস পান করতে পারেন। সুপার শপগুলোতে এই জুস পাবেন।
শারীরিক মিলনের সঙ্গে ইউরিন ইনফেকশনের সম্পর্ক
শারীরিক মিলনের পর নারীদের মূত্রত্যাগ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নয়ত ইউরিন ইনফেকশনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি থাকে। নারীদের মূত্রনালী ছোট হয়। এতে সহজেই ব্যাকটেরিয়া ছড়াতে পারে। মিলনের সময় পুরুষের প্রস্রাবে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া সহজেই নারীদের গোপনাঙ্গে প্রবেশ করে। প্রস্রাব করলে এই ব্যাকটেরিয়া দূর হয়। মিলনের পরপরই গোপনাঙ্গ ভালোভাবে পরিষ্কার করাও জরুরি।
ইউরিন ইনফেকশন হতে পারে শিশুরও
অনেকে ভাবেন এই স্বাস্থ্য সমস্যাটি কেবল বড়দের হয়। এই ধারণা ভুল। শিশুদেরও ইউরিন ইনফেকশন হতে পারে। এমনটা হলে শিশুকে বেশি করে পানি পান করান। এতে বিষাক্ত পদার্থগুলো প্রস্রাবের মাধ্যমে বের হয়ে যাবে। তবে শিশুকে বেশি পানি পান করাতে বাধ্য করা যাবে না। শিশু যদি ছয় মাসের কম বয়সী হয় তবে তাকে যতটা সম্ভব বেশি করে দুধ পান করান।
পানি পান করতে না চাইলে ফলের রস দিতে পারেন। শিশুর বয়স ৬ মাসের বেশি হলে আমলকি, আনারস, ব্লুবেরির রস খাওয়াতে পারেন। এসব ফলের বৈশিষ্ট্য মূত্রনালির ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি রোধে সহায়তা করে। খাওয়াতে পারেন লেবুর রসও।
ইউরিন ইনফেকশন থেকে দূর রাখতে শিশুর ব্যক্তিগত অঙ্গগুলো পরিষ্কার রাখুন নিয়মিত। ডায়াপার পরিবর্তন করুন সময়মতো। নতুন ডায়াপার পরানোর আগে বেবি টিস্যু দিয়ে শিশুর গোপনাঙ্গগুলো পরিষ্কার করে নিন। এসময় আপনার হাতও পরিষ্কার রাখুন।
অনেকেই ইউরিন ইনফেকশনকে সাধারণ সমস্যা ভেবে পাত্তা দেন না। এমনটা করবেন না। শরীর সম্পর্কে সচেতন হোন।