ভাষা হচ্ছে শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, প্রশাসনসহ সব ক্ষেত্রের মূল চালিকাশক্তি। মায়ের ভাষাতেই আমরা খুঁজে পাই জীবন জীবিকার প্রাণশক্তি। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরপরই গভর্নর জেনারেল জিন্নাহর অযৌক্তিক ঘোষণার কারণেই ভাষা আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষার গুরুত্ব অস্বীকার করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের অধ্যায়নরত তদানীন্তন ছাত্র তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বে ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তারের পূর্বেই তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের এই অদ্ভুত কাঠামোতে আর যাই হোক বাঙালির মুক্তি সম্ভব নয়। বাঙালির মুক্তির জন্য প্রয়োজন তাদের স্বাধীন মাতৃভূমি।’
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৬ মে তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের আমন্ত্রণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ।’ (দৈনিক বাংলা, ৭ মে ১৯৭২)।
পৃথিবীর প্রতিটি মাতৃভাষাই যে গুরুত্বপূর্ণ সেই বোধটি এসেছে আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে। ইউনেস্কোর সাধারণ অধিবেশনে ১৯৯৯ সালে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০০০ সাল থেকে সমগ্র বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হয়ে আসছে।
ইউনেস্কোর উদ্যোগে এ বৎসর থেকে ‘ইউনেস্কো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সৃজনশীল অর্থনীতি পুরস্কার’ প্রদান করা হবে। গত বৎসর ১১ই ডিসেম্বর ইউনেস্কোর ২১০তম নির্বাহী বোর্ডের সভায় এই পুরস্কার প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মুজিব শতবর্ষের এই সময়ে বিশ্ব সংস্থা কর্তৃক তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য এ পুরস্কার ঘোষণা আমাদের দারুণভাবে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করে।
বঙ্গবন্ধুর ৪৫তম শাহাদৎ বার্ষিকীতে ইউনেস্কো মহাপরিচালক অদ্রিয়া জুলে যে বাণী দিয়েছেন তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন সর্বদাই অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। তার ভাষায়, ‘It is certain that Bangabandhu’s legacy will continue to be a great source of inspiration for generations to come and for those working to reinvent the world. The Unesco shares this aspiration for an inclusive, equitable, and democratic society – a dream that Bangabandhu presented on March 7, 1971 in a historic speech now inscribed on Unesco Memory of the World International Register.’
ইতোপূর্বে ইউনেস্কোর ১০ম মহাপরিচালক ইরিনা বকোভা ৩০শে অক্টোবর, ২০১৭ তারিখে ঘোষণা করেন যে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য-স্মারক তালিকায় (Memory of the World International Register) সংযোজিত হয়েছে। ১৯৯৭ সাল থেকে বিশ্ব সভ্যতার ঐতিহ্য-স্মারক তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করে ইউনেস্কো।
মানব সভ্যতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ দালিলিক ঐতিহ্যসমূহ সংরক্ষণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সহজে অভিগম্য করার লক্ষ্যে ইউনেস্কো এই কর্মসূচি গ্রহণ করে।
আন্তর্জাতিক সাময়িকী নিউজউহক কর্তৃক ‘রাজনীতির কবি’ বলে অভিহিত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল প্রকৃতপক্ষে রাজনীতির মহাকাব্য। রাজনীতির লক্ষ্য যদি হয় জনগণের কল্যাণ, তাহলে স্বাধীনতা অর্জন ও সমুন্নত রাখাই হবে জনকল্যাণের সর্বোচ্চ ধাপ। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ মূলত বাঙালি জাতির মুক্তির মহাকাব্য।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণ সম্পর্কে বলেন, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্তপর্বে ৭ই মার্চের এই ভাষণ গোটা জাতিকে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে। জাতির পিতার এই সম্মোহনী ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালি জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্রই ছিল ৭ মার্চের এই অনন্যসাধারণ ভাষণ।
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে মানবমুক্তির চিরন্তন সত্যটি জোরালোভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে এবং অন্ধকারকে পেছনে ফেলে আলোর পথে যাত্রার গতিপ্রবাহ সৃষ্টি করেছে। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের বিশ্ব প্রাসঙ্গিকতা চিরদিন থাকবে কারণ বাঙালির মুক্তি তথা মানবমুক্তি একটি শাশ্বত সত্য যার ওপর ভিত্তি করে মানবসভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে।
ইতিহাসবিদ ও লেখক জ্যাকব এফ ফিল্ড সম্পাদিত ‘We Shall Fight On The Beaches’ পুরো পৃথিবীকে আন্দোলিত করেছে এমন ৪১টি ভাষণের মাঝে স্থান করে নিয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। খৃষ্টপূর্ব ৪৩১ সাল থেকে ১৯৮৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ সময়কালের ইতিহাসে যে ভাষণসমূহ মানবসভ্যতায় স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে, কালজয়ী অনুপ্রেরণাদায়ী সে ভাষণগুলোই এ গ্রন্থের আধেয়।
একটি ভাষণ যে কত শক্তিশালী হতে পারে, নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র বাঙালিতে রূপান্তর করতে পারে ও পরাধীন বাঙালিকে স্বাধীন জাতিসত্তা দিতে পারে তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ। ৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানের চিত্র উত্থাপন করে পরবর্তী দিন আট মার্চ তারিখের দৈনিক ইত্তেফাকে ‘উত্তাল-উদ্দাম জলধিতরঙ্গ’ শিরোনামে লেখা হয়- ‘৭ মার্চ একটি অবিস্মরণীয় দিন। অনন্যসাধারণ এই দিনের ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান। অবিস্মরণীয় এই অনন্যদিনের রেসকোর্সে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার নির্দেশকামী স্বাধিকার সৈনিকদের সংগ্রামী সম্মেলন। সংগ্রামী বাংলা দুর্জয় দুর্বিনীত।’
অধুনালুপ্ত ‘দৈনিক পাকিস্তান’ ‘লক্ষকণ্ঠের বজ্রশপথ’ শিরোনামে পরদিনের (৮ মার্চ, ১৯৭১) পত্রিকায় বর্ণনা করে ‘লক্ষ হস্তে শপথের বজ্রমুষ্টি মুহুর্মুহু উত্থিত হচ্ছে আকাশে। জাগ্রত বীর বাঙালির সার্বিক সংগ্রামের প্রত্যয়ের প্রতীক, সাত কোটি মানুষের সংগ্রামী হাতিয়ারের প্রতীক বাঁশের লাঠি মুহুর্মুহু স্লোগানের সঙ্গে সঙ্গে উত্থিত হচ্ছে আকাশের দিকে। এই ছিল রবিবারের (৭ মার্চ, ১৯৭১) রমনার রেসকোর্স মায়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সভার দৃশ্য।’
‘জয় জনতার জয়’ শিরোনামে দৈনিক ইত্তেফাক পরদিন অর্থাৎ ৮ মার্চ, ১৯৭১ তারিখে রিপোর্ট করে যে গভীর রাত্রিতে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, ‘সামরিক কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত ঢাকা বেতার হইতে শেখ মুজিবুর রহমানের রমনা রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত ভাষণের পূর্ণ বিবরণ প্রচারের অনুমতি দিতে স্বীকৃত হইয়াছেন। সোমবার (৮ মার্চ, ১৯৭১) সকাল সাড়ে ৮ ঘটিকায়, ঢাকা বেতার কেন্দ্র হইতে শেখ মুজিবুর রহমানের রমনা রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত ভাষণ প্রচার করা হইবে। বাংলার অন্যান্য বেতারকেন্দ্র হইতেও ইহা রিলে করা হইবে।’
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও হত্যাকাণ্ডের দোসররা দীর্ঘ একুশ বৎসর বঙ্গবন্ধুর এই সম্মোহনী ভাষণটিকে একদিনের জন্যও প্রচার করেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের একুশ বৎসর পর ১৯৯৬ সালের ২৩শে জুন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রথমবারের মত এই ভাষণ সম্প্রচার করে।
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ একাত্তরের অপরাহ্নে যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন বেতার-টেলিভিশন বন্ধ করার যে ঘটনা ঘটিয়েছিল পাকিস্তানি শাসকেরা, ঠিক তেমনই ঘটনা আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে। ৮ মার্চ, ১৯৭১ তারিখের সংখ্যায় অধুনালুপ্ত দৈনিক আজাদ ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র নীরব’ শিরোনামে নিম্নোক্ত সংবাদ পরিবেশন করে—
‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র গতকাল রবিবার সহসা স্তব্ধ হইয়া যায়। অপরাহ্ন ৩টা ১৫ মিনিট হইতে এই কেন্দ্র আর কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করে নাই। কবে আবার এই কেন্দ্র চালু হইবে - সংশ্লিষ্ট কোনো মহলই গতকাল তাহা জানাইতে পারে নাই।’
‘গতকাল বেতারে বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সের ভাষণ প্রচারের কথা ছিল। তদানুযায়ী ব্যবস্থাও করা হয়। বঙ্গবন্ধু যখন রেসকোর্সে বক্তৃতা-মঞ্চে আরোহণ করেন, তখন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ এই গানটি প্রচার করা হয়। কিন্তু নেতার বক্তৃতা শুরু হওয়ার পর নাকি একটি মহল ইহা রিলে করিতে বাধা দেয়। অত:পর, রোসকোর্স ময়দান হইতেই শেখ মুজিবুর রহমান বেতারের বাঙালি কর্মচারীদের অসহযোগ শুরু করার আহ্বান জানান। সঙ্গে সঙ্গে কর্মচারীগণ নিজ নিজ দায়িত্ব ত্যাগ করিয়া রাস্তায় নামিয়া আসে এবং বেতারও স্তব্ধ হইয়া যায়।’ (আজাদ, ৮ মার্চ ১৯৭১)
ঐদিন অর্থাৎ ৭ই মার্চ (১৯৭১) সন্ধ্যায় ঢাকায় অবস্থানরত গণঐক্য আন্দোলনের প্রধান অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান যখন এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘শেখ মুজিবের গৃহীত সব ব্যবস্থাই যুক্তিসংগত এবং সংখ্যাগুরু প্রতিনিধির বৃহত্তম দলের প্রধান হিসাবে শেখ মুজিবের দেশকে শাসন করার ন্যায্য অধিকার রহিয়াছে।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পেছনে এই ভাষণের ভূমিকা ও তাৎপর্য অনুধাবন করে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তাই এই ঐতিহাসিক ভাষণটি আজ আমাদের সংবিধানের অংশ।
আজ থেকে পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণ যোগাযোগ বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক প্রয়োগের এক বিস্ময়কর ঘটনা। যোগাযোগ বিষয়ে আধুনিক নিয়ম-কানুনের এক আশ্চর্য প্রতিফলন ঘটেছে এ ঐতিহাসিক ভাষণে। প্রতি মিনিটে গড়ে ৫৮ থেকে ৬০টি শব্দ উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু ১৯ মিনিটে এ কালজয়ী ভাষণটি শেষ করেছিলেন। সম্প্রচারতত্ত্বে প্রতি মিনিটে ৬০ শব্দের উচ্চারণ একটি আদর্শ হিসাব। একহাজার একশত সাতটি শব্দের এ ভাষণে কোনো বিরক্তিকর পুনরাবৃত্তি নেই, কোনো বাহুল্য নেই— আছে শুধু সারকথা, সারমর্ম। তবে দু-একটি স্থানে পুনরাবৃত্তি বক্তব্যের অন্তর্লীন তাৎপর্যকে বেগবান করেছে।
ভাষণের সূচনাপর্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়ে থাকে ‘There is nothing like a good beginning for a speech’। বক্তব্যের প্রারম্ভে শ্রোতার মানসিক অবস্থান (audience orientation) ও সাম্প্রতিক ঘটনা উল্লেখ করা অত্যাবশ্যক বলে যোগাযোগতত্ত্বে যা বলা হয় (reference to audience and reference to recent happenings) তার আশ্চর্য প্রতিফলন ঘটে বঙ্গবন্ধুর এ যুগান্তকারী ভাষণে।
বঙ্গবন্ধু ভাষণ শুরু করেছিলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’ অত্যন্ত কার্যকর বক্তৃতার অবতরণিকা- যা পুরো বক্তৃতার মূলভিত্তি তৈরি করেছে ও শ্রোতাকুলকে অভ্যুদিত বক্তৃতার আভাস দিল।
পুরো বক্তৃতার আধেয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বক্তৃতাটি মূলত পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন দেশের অভ্যুদয়বার্তা ও তার স্বাভাবিক অনুযাত্রায় পাকিস্তানের তদানীন্তন রাষ্ট্রকাঠামোর পূর্বাঞ্চলের পরিসমাপ্তির প্রজ্ঞপ্তি ও বিবরণী।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ও মূলসূত্র ৭ মার্চের এ বক্তৃতা। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এ বক্তৃতা ছিল আমাদের সিংহনাদ বা যুদ্ধস্লোগান। শিশু-কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ সকলের গায়ের রোম খাড়া হয়ে যেত এ বক্তৃতা শ্রবণে। বঙ্গবন্ধুর স্বকণ্ঠে বক্তৃতা সাড়ে সাতকোটি বাঙালিকে শুধু ঐক্যবদ্ধই করেনি, মাত্র আঠার দিন পর তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিল। কারণ, এ ভাষণই ছিল কার্যত (de facto) বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
‘আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাইনা’- বঙ্গবন্ধুর এই উচ্চারণ প্রসঙ্গে প্রয়াত সাংবাদিক-সম্পাদক কামাল লোহানী বলেছিলেন, ‘সংসদীয় রাজনীতির অঙ্গনে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার এই বলিষ্ঠতা একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই দেখাতে পেরেছিলেন বলে তিনি জাতিরাষ্ট্র-স্রষ্টা এবং মুক্তিদাতা হিসেবে মহত্ত্ব অর্জন করেছিলেন।’
জনযোগাযোগে যেসব speech-idiom ব্যবহার করার কথা তা অত্যন্ত সঠিকভাবে সুপ্রযুক্ত হয়েছে বক্তৃতায়। বাংলাদেশের জন্মের প্রাক্কালে বাংলার জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতার সংলাপ এ বক্তৃতা। প্রাঞ্জল কথোপকথনের ভঙ্গিমায় অতি সহজ সাবলীল ভাষায় তাৎক্ষণিকভাবে রচিত এ ভাষণ আমাদের স্বাধীনতার মূল দলিল। শ্রোতাকে আকর্ষণ করার লক্ষ্যে তিনি সংলাপের বাচনশৈলী অনুসরণ করেছিলেন অত্যন্ত সূচারুভাবে। বক্তৃতার বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। সরাসরি সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন পাঁচটি— কি অন্যায় করেছিলাম? কি পেলাম আমরা? কিসের আরটিসি? কার সঙ্গে বসব? যারা আমার মানুষের রক্ত নিয়েছে তাদের সঙ্গে বসব?
বক্তার সঙ্গে শ্রোতার মেলবন্ধন সৃষ্টিতে ‘ask question and then answer’ পরামর্শের সুপ্রয়োগ ঘটেছে এ ভাষণে। পুরো ভাষণে বর্তমানকালের যৌক্তিক ব্যবহার বক্তৃতাটিকে সজীবতা দিয়েছে। আবার কথোপকথনের ধারার স্বার্থে তিনি অতীত ও ভবিষ্যৎকালের সুন্দর সংমিশ্রণও ঘটিয়েছেন এ বক্তৃতায়।
বক্তৃতার যেসব অংশে বঙ্গবন্ধু আদেশ, নির্দেশ বা সতর্ক সংকেত দিচ্ছেন সেসব স্থানে বাক্যগুলো স্বাভাবিকভাবে সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। বহু গবেষণার পর যোগাযোগতাত্ত্বিকদের declarative বাক্য সংক্ষিপ্ত করার বর্তমান নির্দেশিকা বঙ্গবন্ধুর ভাষণে যথাযথ প্রতিফলিত। ভাষণ থেকে কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন, ‘২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন’; ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’; ‘সরকারি কর্মচারীদের বলি— আমি যা বলি তা মানতে হবে’; ‘যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হল, কেউ দেবে না’; ‘সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে দাবায়ে রাখতে পারবা না’।
রাষ্ট্রনায়কোচিত ও কর্তৃত্বব্যঞ্জক বক্তৃতার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভবিষ্যৎ কর্মোদ্যোগ, কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে শ্রোতাদের শুধু পরিচিতি করানোই নয়, বরং তাদের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করা। বঙ্গবন্ধু কাজটি অত্যন্ত সফলভাবে সাধন করেছিলেন তার এ বক্তৃতার মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর প্রোৎসাহমূলক বক্তব্য— ‘তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দেওয়ার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ সাড়ে সাতকোটি বাঙালি এ বক্তব্যকেই হুকুমনামারও অধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাদেশ বলে সেদিন গ্রহণ করেছিলেন।
মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কঠিন সতর্কবাণী উচ্চারণের সময়ও তার মানবিক উদারতার কোনো হেরফের কখনো যে ঘটেনি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ ৭ মার্চের ভাষণ। রাষ্ট্রের জন্মমৃত্যুর সংযোগস্থলে দাঁড়িয়েও তিনি ‘আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই আবার আশ্বাসবাণী উচ্চারণ করেন— ‘তোমরা আমার ভাই— তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপরে গুলি চালাবার চেষ্টা করো না।’ কঠিনের সঙ্গে কোমলের এমন সহাবস্থান উদার-হৃদয় বঙ্গবন্ধুর মাঝে সর্বদাই বিদ্যমান ছিল।
যথাযথ তথ্য চয়নের ফলে বক্তৃতাটি অত্যন্ত তথ্যনিষ্ঠ হয়েছে, আর তীক্ষ্ণ যুক্তিবিন্যাসের কারণে শ্রোতাদের মাঝে তীব্র প্রণোদনা সঞ্চারে সক্ষম হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়-‘যে আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী-আর্ত মানুষের মধ্যে। তার বুকের উপর গুলি হচ্ছে। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ, আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।’ সহজ ভাষায় এ ধরনের জোরালো যুক্তিবাদ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের এক সহজাত বিশেষত্ব। বক্তব্যের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য বক্তৃতার মাঝামাঝি এসে সূচনা বক্তব্যের সম্প্রসারণ বা পুনরাবৃত্তির কথা বলা হয় যোগাযোগ বিজ্ঞানে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে আশ্চর্যজনকভাবে এ দিকটিও প্রতিভাসিত যখন তিনি বক্তৃতার মাঝামাঝি এসে বলেন, ‘তাকে আমি বলেছিলাম, জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপরে গুলি করা হয়েছে। কি করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। কি করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন।’
অন্যের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিতে যেয়ে বঙ্গবন্ধু ‘put up the attribution first’-এর নিয়মনীতি যথাযথভাবে অনুসরণ করেছেন। বক্তার নাম প্রথম উল্লেখ করে তারপর তার মন্তব্য/বক্তব্য উত্থাপন করেছেন। যেমন— ‘ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না’ কিংবা ‘ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন। তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম’ ইত্যাদি। সার্বজনীন ভাষণের একটি প্রধান দায়িত্ব কর্মসূচি নির্ধারণ (agenda setting function) যা বঙ্গবন্ধুর এ বক্তৃতায় সুস্পষ্টভাবে এসেছে বারবার। কিন্তু কঠোর কর্মসূচি প্রদানকালেও বঙ্গবন্ধুর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির (humanistic approach) যে কোনো তারতম্য ঘটত না— তার স্বাক্ষর নিম্নোক্ত বক্তব্য:
‘আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট, কাছারি, ফৌজদারি আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সেজন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল, কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে। কিন্তু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি-গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো-ওয়াপদা, কোনো কিছু চলবে না।’
জনযোগাযোগে ব্যক্তি বা ঘটনার মর্যাদা আরোপণ (status conferral function) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার বিভিন্ন অংশে এ বিধানের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। যেমন— তিনি বলেছেন, ‘আর এই সাতদিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছেন প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছে দেবেন’ কিংবা ‘আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যতদূর পারি ওদের সাহায্য করতে চেষ্টা করব।’
সার্বজনীন বক্তব্যে ও জনযোগাযোগে কার্যকর ফল লাভের জন্য চ্যালেঞ্জ উত্থাপন (posing a challenge) সর্বজনবিদিত একটি পদ্ধতি। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতার শেষপর্যায়ে এসে যখন বলেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব— এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইন্শালাহ’, তখন বোঝা যায় যে তিনি যোগাযোগবিদ্যার শিল্পকুশল প্রণালীতে পরম দক্ষতায় কীভাবে শ্রোতাদের বক্তৃতার সঙ্গে গেঁথে ফেলেছেন।
যে কোনো বক্তৃতার সংজ্ঞানির্ধারণী অংশ সাধারণত শেষেই উচ্চারিত হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে যোগাযোগবিদদের আধুনিক অভিমত। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের শেষবাক্য ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, অত্যন্ত দৃঢ়প্রত্যয়ে ব্যক্ত স্বাধীনতার কার্যত ঘোষণা— যা ৭ মার্চের বক্তৃতার সংজ্ঞা হিসাবে স্বীকৃত। যে প্রক্রিয়ায় তিনি ভাষণ শেষ করেছেন তা যোগাযোগবিদ্যার পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়, যেখানে বলা হয় ‘Don't drag out your conclusion’। আমরা প্রায়ই ‘পরিশেষে বলছি’, ‘একটি কথা বলেই শেষ করছি’ বা ‘পরিশেষে এ কথাটি না বললেই নয়’ ইত্যাদি ভূমিকা করে বক্তব্য শেষ করি। কিন্তু এই ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু সরাসরি speech definition-এ প্রবেশ করেছেন, যা আধুনিক তত্ত্বের যথাযথ প্রয়োগ এবং যা ছিল পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে অকল্পনীয়।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল (১৮৪৭-১৯৬৫) ১৯৪০ সালের ৪ জুন তার বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘We shall fight on the beaches, we shall fight on the landing grounds, we shall fight in the fields and in the streets, we shall fight in the hills, we shall never surrender’। এখানে ‘we shall fight’ ছিল বক্তৃতার সংজ্ঞা।
একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মার্টিন লুথার কিং (১৯২৯-১৯৬৮) ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, তার সংজ্ঞা অংশ ছিল ‘I have a dream’। উক্ত বক্তৃতার একটি অংশ ছিল— ‘I have a dream that one day this nation will rise up and live out the true meaning of its creed. We hold these truths to be self evident that all men are created equal, I have a dream that my four little children will one day live in a nation where they will not be judged by the colour of their skin, but by the content of their character’.
যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের (১৮০৯-১৮৬৫) ১৮৬৩ সালের ১৯শে নভেম্বর প্রদত্ত গেটিসবার্গ বক্তৃতায় ‘and that government of the people, by the people, for the people, shall not perish from the earth’ কিংবা ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর (১৮৮৯-১৯৬৪) ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্ট মধ্যরাতে প্রদত্ত ভাষণের ‘A tryst with destiny’ একইভাবে বক্তৃতায় সংজ্ঞা নির্ধারণ করে।
আমরা জানি যে, বলিষ্ঠ বক্তব্য সর্বদাই সংক্ষিপ্ত হয়। একাত্তরের ৭ মার্চ তারিখে প্রদত্ত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তট-অতিক্রমী ভাষণ তেজস্বী বক্তৃতার এক শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। একটি ভাষণ একটি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে কী দারুণভাবে উৎসাহিত করেছিল— তা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা ও স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ কণ্ঠস্বরসংবলিত এ ভাষণের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও সময়োপযোগিতা বিশ্লেষণ গবেষকদের জন্য এক স্বর্ণখনি। এ ভাষণ বাঙালিকে যেভাবে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উদ্দীপ্ত ও দীক্ষিত করেছিল, তা পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছে নতুন এক বক্তৃতা আলেখ্য। সার্বজনিক বক্তৃতাবিশারদ, গবেষক ও যোগাযোগবিদদের জন্য এ ঐতিহাসিক ভাষণ একটি আবশ্যিক পাঠক্রম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে দেশে-বিদেশে। আমাদের প্রাত্যহিক চিন্তা চেতনা ও আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিশীলিত ও স্বচ্ছ উপস্থাপনা সার্বজনিক সম্ভাষণ বা Public Address -এ অন্যতম শর্ত।
এ প্রসঙ্গে ডেল কার্নেগীর উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ‘The best argument is that which seems merely an explanation’ অর্থাৎ সর্বোত্তম যুক্তি হচ্ছে শুধুই সঠিক ব্যাখ্যা। তৎসময়ের ঘটনাবলীর আনুপূর্বিক প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা এ ভাষণটিকে সব সময়ের জন্য যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলেছে।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক অভিভাষণ বঙ্গবন্ধুর extempore speech হলেও লক্ষণীয় যে উপস্থিত বক্তৃতার সচরাচর পরিদৃষ্ট লক্ষণ, যেমন বিরক্তিকর পুনরাবৃত্তি, শব্দচয়নে মুহূর্তের দ্বিধাগ্রস্ততা ইত্যাদি ছিল একেবারেই অনুপস্থিত। বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে কোনো টীকা বা নোট ব্যতিরেকে এমন নির্মোদ ও নির্দেশনামূলক ও একই সঙ্গে কাব্যময় বক্তৃতা প্রদান একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই সম্ভব বিধায় আন্তর্জাতিক সাময়িকী নিউজউইক তখনই বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজনীতির কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছিল একাত্তরের ৫ এপ্রিলে প্রকাশিত তাদের প্রচ্ছদ নিবন্ধে। এ বক্তৃতা আক্ষরিক অর্থেই ছিল একটি বিপ্লব, যার ফল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা। শব্দের এমন সুপ্রযুক্ত ব্যবহার সত্যিই এক বিস্ময়কর ঘটনা।
বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় শব্দের ব্যবহার বিশ্লেষণ করলে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি টমাস জেফারসনের (১৭৪৩-১৮২৬) বিখ্যাত উক্তি ‘the most valuable of all talents is that of never using two words when one will do’ আমাদের স্মরণে আসে। ৭ মার্চ একাত্তরের এ ভাষণ বাংলা ভাষায় শুধু শ্রেষ্ঠ ভাষণ নয়, পৃথিবীর একটি অনন্যতম ভাষণ। কারণ এ ভাষণ আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা।
এ ভাষণ যুগ যুগ ধরে বাঙালি জাতিকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় উজ্জীবিত রাখবে, জীবনসত্য অনুধাবনে পথ দেখাবে ও বাঙালির সার্বিক মুক্তি আন্দোলনকে দেবে রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা। সেলিনা হোসেনের মতে, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের সেই মহামানব, সময় যাকে সৃষ্টি করেনি, যিনি সময়কে নিজের করতলে নিয়ে এসেছেন।’ বঙ্গবন্ধু যে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন তা যুগ যুগ ধরে বাঙালিকে মুক্তির পথ দেখাবে।
রবীন্দ্রনাথের একশত সতের বৎসর পূর্বে মুক্তির অনুসন্ধানে রচিত যে রবীন্দ্র পঙক্তি এ প্রবন্ধের শিরোনামের পর উদ্ধৃত করা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু মানবজাতির সেই সার্বিক মুক্তির ঠিকানা দিয়ে গেছেন ৭ই মার্চের ভাষণে। তাই ইউনেস্কো আজ বিশ্ব ঐতিহ্য-স্মারক তালিকায় বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণকে সংযোজিত করে মানবমুক্তির চলমান যাত্রাকে আরও গতিশীল করার পদক্ষেপ নিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের এ সময়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সেই সর্বাঙ্গীণ মুক্ত সমাজ গঠনে আসুন আমরা সঙ্কল্পবদ্ধ হই।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ বেলাল রিজভী
ই-মেইলঃ news.dailybibartan@gmail.com
ফোনঃ +8801611572441