১০৯-এ ফোন দিয়ে বন্ধ হয়েছে ৯৩% বাল্যবিবাহ
logo
ঢাকা, শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

১০৯-এ ফোন দিয়ে বন্ধ হয়েছে ৯৩% বাল্যবিবাহ

নিজস্ব প্রতিবেদক
নভেম্বর ২২, ২০২১ ৮:৪৫ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

আরজু আক্তারের বয়স এখনো ১৮ পেরোয়নি। অথচ এ বয়সেই আড়াই বছরের এক কন্যাসন্তানের মা সে। স্বামী তাকে ছেড়ে গেছে। এই নারী গৃহকর্মী একাই বড় করছে তার সন্তানকে। আরজু আক্তারের আফসোস, ‘মায় মাত্র ১৪ বছরে আমার বিয়াটা না দিলে এহন নিজের মতো থাকতে পারতাম। মাইয়াটার খাওয়া-পরার কথা ভাবন লাগত না।’

আরজু একা নন, ইউনিসেফের (আন্তর্জাতিক শিশুবিষয়ক সংস্থা) ২০২০ সালের এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের ৫১ শতাংশেরই বিয়ে হয়েছে শিশু থাকা অবস্থায়। এর ফলে বাংলাদেশ ৩ কোটি ৮০ লাখ “শিশু কনে”র দেশে পরিণত করেছে। আবার এদের মধ্যে ১ কোটি ৩০ লাখ নারীর বিয়ে হয়েছে তাদের বয়স ১৫ বছর হওয়ার আগেই।

বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ বড় সমস্যা হয়ে সামনে এলে, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারিভাবেও এটি প্রতিরোধে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার ফর ভায়োলেন্স অ্যাগেইনসট উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন। ২০১২ সাল থেকে তারা একটি হেল্পলাইন পরিচালনা করে আসছে, সেটি হলো ‘১০৯’। প্রায় ১০ বছরে এই হেল্পলাইনে বাল্যবিবাহ বন্ধে সাহায্য চেয়ে ফোন এসেছে ৯ হাজার ৩৮৮টি। এর মধ্যে ৮ হাজার ৭৫৫টি ক্ষেত্রেই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ ৯৩ শতাংশই ঠেকানো গেছে।

ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার ফর ভায়োলেন্স অ্যাগেইনসট উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেনের প্রোগ্রাম অফিসার রাইসুল ইসলাম বলেন, ‘বাল্যবিবাহের মতো একটি সামাজিক ব্যাধি প্রতিরোধে ১০৯ হটলাইন নম্বরটি চালু করা একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। আমাদের এখানে বাল্যবিবাহসংক্রান্ত ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সেটা বন্ধে কাজ শুরু করি।’ তিনি বলেন, কোনো ফোন এলে ভুক্তভোগীর ঠিকানা ও পরিচয় লিপিবদ্ধ করা হয়। এরপর স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে যেখানে বাল্যবিবাহের চেষ্টা চলছে, সেখানে তাঁদের যেতে বলা হয়। এরপর খোঁজ রাখা হয় যে বাল্যবিবাহটা বন্ধ করা গেল কি না!

গত ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ উপজেলায় জান্নাত নামের ১৪ বছর বয়সী একটি মেয়েশিশুকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছিল। ওই দিন সকাল ১০টায় স্থানীয় এক ব্যক্তি হেল্পলাইনে ফোন করে বিষয়টি জানান। হেল্পলাইন থেকে তখনই ইউএনওর সঙ্গে যোগাযোগ করে বিয়ে ঠেকানোর অনুরোধ করা হয়। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেন তিনি। বাল্যবিবাহ থেকে রেহাই পায় জান্নাত।

করোনাকালে দেশে বাল্যবিবাহের চিত্র আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) তথ্য অনুযায়ী, টানা দেড় বছরের ছুটি শেষে গত সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর দেখা গেছে, প্রাথমিকে ২০ এবং মাধ্যমিকে ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী স্কুলে ফেরেনি। শিক্ষার্থীদের স্কুলে না ফেরার অন্যতম কারণ বাল্যবিবাহ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, ‘আমাদের দেশে সচ্ছল বা অসচ্ছল প্রায় সব পরিবারেই মেয়েদের বোঝা মনে করা হয়। এ জন্য মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়।

আর করোনায় যখন স্কুল-কলেজ বন্ধ, তখন সচ্ছল পরিবারেও অনেক বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে। করোনার পর যখন স্কুল-কলেজগুলো খুলল, আমরা আশা করেছিলাম, সব শিক্ষার্থীই আবার স্কুলে ফিরবে।

কিন্তু আমরা দেখলাম বহু মেয়েই আর স্কুলে ফেরেনি।’

বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাকালে বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ৬৫টি করে বাল্যবিবাহ হয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের জরিপে দেখা গেছে, করোনাকালে বাল্যবিবাহ বেড়েছে ১৩ শতাংশ। যা গত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য বলছে, কেবল গত দুই মাস অর্থাৎ সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৪২৮ জন কন্যাশিশু। ব্র্যাকের গবেষণা বলছে, করোনাকালে ৮৫ শতাংশ বাল্যবিবাহের কারণ ছিল মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা। ৭১ শতাংশ বিয়ে হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে।

এ বিষয়ে ব্র্যাকের রিসার্চ অ্যান্ড এভিডেন্স শাখার টিম লিডার আবু সাইদ মোহাম্মদ জুয়েল বলেন, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, এ সময়ের মধ্যে যতগুলো বিয়ে হয়েছে তার মধ্যে ৭৭ শতাংশই ছিল বাল্যবিবাহ। তিনি মনে করেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকারি যে হটলাইন নম্বর আছে, সেগুলোর বিষয়ে আরও প্রচার দরকার। তাঁর মতে, বেশির ভাগ বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটে একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। সেখানকার খুব কম মানুষই এ ধরনের হেল্পলাইনের নম্বর সম্পর্কে ধারণা রাখেন।

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ২০১৭ সালে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’ জারি হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়ের বয়স হতে হবে কমপক্ষে ১৮ বছর এবং ছেলের বয়স কমপক্ষে ২১। প্রাপ্তবয়স্ক কেউ বাল্যবিবাহ করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং এ জন্য দুই বছরের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডেরও বিধান রাখা হয়েছে। আর অপ্রাপ্তবয়স্ক কেউ বাল্যবিবাহ করলে এক মাসের আটকাদেশ ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে। এ ছাড়া বাল্যবিবাহের সঙ্গে অভিভাবক বা অন্য কেউ জড়িত থাকলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। যিনি বিয়ে পড়াবেন কিংবা নিবন্ধন করবেন তারও ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে।

‘১০৯’–এর মতোই ‘৯৯৯’ ও ‘৩৩৩’-এ ফোন দিয়েও বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে। এ ছাড়া ‘বন্ধন’ নামে একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মও চালু করতে যাচ্ছে সরকার। এই প্ল্যাটফর্মে বিয়ে নিবন্ধন ও বিচ্ছেদের সব তথ্য সংরক্ষিত থাকবে বলে জানিয়েছেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কাজি বলেন, বিয়ে নিবন্ধনের ক্ষেত্রে হাতে-কলমে তথ্য লিপিবদ্ধ থাকে বলে, অনেকেই এই সুযোগটা নিয়ে বিয়ে পড়িয়ে দেন। যদি বিয়ে পড়ানোর পরপরই ডিজিটাল মাধ্যমে সমস্ত তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকে, তাহলে কাজিরা বাল্যবিবাহ পড়ানো থেকে বিরত থাকবেন।

দৈনিক বিবর্তন এর প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।