এক হাজার কোটি (১০ বিলিয়ন) ডলারের মাইলফলক ছাড়িয়েছে বিদেশি ঋণ। করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় ওলটপালট হয়ে যাওয়া বিশ্ব পরিস্থিতিতে কম সুদের বিদেশি ঋণ প্রাপ্তিতে এই রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ-ইআরডি জানিয়েছে, ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ১ হাজার কোটি ৮৩ লাখ ৮০ হাজার ডলারের ঋণসহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ।
বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে (প্রতি ডলার ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। এই অঙ্ক আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি।
দেশের ইতিহাসে এর আগে কোনো অর্থবছরের এত বেশি বিদেশি ঋণ আসেনি।
তবে পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলা আমেরিকান মুদ্রা ডলারের অস্থির বাজারে টাকার অব্যাহত দরপতনে এই বিদেশি ঋণ নিয়ে চিন্তিত অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলছেন, ‘দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা মহামারির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ঋণসহায়তা পাওয়ায় এই উল্লম্ফন হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে এই ঋণ পাওয়া গেলে খুবই ভালো হতো। কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে, এই ঋণ তো আমরা প্রতি ডলার ৮৪/৮৫ টাকা হিসাবে পেয়েছি। এখন ডলারের দর ১১০ টাকায় উঠেছে। আরও কত বাড়বে, কে জানে। আমাদের ঋণের বোঝা কিন্তু অনেক বেড়ে গেল।’
ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৭৯৫ কোটি ৭৫ লাখ ৬০ হাজার (৭.৯৬ বিলিয়ন) ডলার ঋণসহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ।
তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছিল ৭৩৮ কোটি (৭.৩৮ বিলিয়ন) ডলার।
বাংলাদেশে বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে। ওই বছরই এক লাফে অর্থছাড় ৩০০ কোটি থেকে ৬৩৭ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। তারপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আসে ৬৫৪ কোটি ডলার।
শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ নিয়েও নানা কথা হচ্ছে। যদিও দুই দেশের তুলনা নাকচ করছেন অর্থনীতির বিশ্লেষকেরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের জিডিপির তুলনায় বৈদেশিক ঋণ এখনও ১৩ শতাংশের নিচে; আর শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে তা ৫০ শতাংশের কাছাকাছি।
ইআরডি বৃহস্পতিবার বিদেশি ঋণসহায়তার প্রতিশ্রুতি ও ছাড়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের বাংলাদেশকে ৮২০ কোটি ৫০ লাখ ৩০ হাজার (৮.২০ বিলিয়ন) ডলার ছাড় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দাতারা। পাওয়া গেছে ১ হাজার কোটি ৮৩ লাখ ডলার।
এ হিসাবে গত অর্থবছরে দাতারা বাংলাদেশকে যে ঋণ দিতে চেয়েছিল তার থেকেও ২২ শতাংশ বেশি ছাড় করেছে। বিদেশি ঋণসহায়তা প্রাপ্তিতে এমনটা বিরল।
ছাড় করা ঋণের মধ্যে ১ হাজার কোটি ৮৩ লাখ ৮০ হাজার ডলার পাওয়া গেছে প্রকল্প সাহায্য হিসেবে। ১৯ কোটি ৭৬ লাখ ২০ হাজার ডলার পাওয়া গেছে অনুদান। এর মধ্যে ২৫ লাখ ৩০ হাজার ডলার খাদ্য অনুদান এবং ১৯ কোটি ৫০ লাখ ৯০ হাজার ডলার প্রকল্প অনুদান হিসেবে পাওয়া গেছে।
২০২০-২১ অর্থবছরের ৭৯৫ কোটি ৭৫ লাখ ৬০ হাজার ডলার ছাড় করেছিল দাতারা।
সে হিসাবেই গত অর্থবছরে বিদেশি ঋণসহায়তা বেড়েছে ২৬ শতাংশ।
প্রতিশ্রুতি কমেছে ১৩.১০ শতাংশ
ইআরডির তথ্য বলছে, গত অর্থবছরে দাতাদের ঋণসহায়তার প্রতিশ্রুতি কিছুটা কমেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের ৯৪৪ কোটি ২৩ লাখ ৭০ হাজার ডলারের ঋণসহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দাতারা। গত অর্থবছরে সেই প্রতিশ্রুতির পরিমাণ কমিয়ে ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ কমিয়ে ৮২০ কোটি ৫০ লাখ ৩০ হাজার ডলারে নামিয়ে আনেন দাতারা।
সুদ পরিশোধ বেড়েছে ৫.১৮ শতাংশ
২০২১-২২ অর্থবছরে আগে নেয়া ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ। এ সময়ে সরকার আসল ও সুদ বাবদ উন্নয়ন সহযোগীদের ২০১ কোটি ৪১ লাখ ৩০ হাজার ডলার শোধ করেছে। গত অর্থবছরে সুদ-আসল পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১১৯ কোটি ৪৮ লাখ ১০ হাজার ডলার।
উদ্বেগও আছে
বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বিদেশি ঋণ বাড়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কম সুদের বিদেশি ঋণসহায়তা বাংলাদেশের উন্নয়নে বরাবরই অবদান রেখে চলেছে। দুই-আড়াই বছরের মহামারির পর এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ গোটা বিশ্ব অর্থনীতিকেই পাল্টে দিয়েছে। এরপরও এখন পর্যন্ত আমরা মোটমুটি ভালো অবস্থায় আছি। এই ঋণ আমাদের অর্থনীতির গতি ইতিবাচক ধারায় রাখতে অবদান রাখছে।’
‘তবে আমেরিকান মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার অব্যাহত দরপতন আমাদের বিপদে ফেলে দিয়েছে; উদ্বেগেরও সৃষ্টি করেছে। ব্যাংকে ডলারের দাম ১১০ টাকায় উঠে গেছে। এই যে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ আমরা নিয়েছি, সেটা কিন্তু ৮৪, ৮৫ কিংবা ৮৬ টাকায় নিয়েছিল। ডলারের দাম যদি এভাবে বেড়েই চলে, তাহলে কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা জানি না। সে ক্ষেত্রে এই ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে কত টাকা দরে ডলার কিনে শোধ করতে হবে, সেটাই এখন উদ্বেগের বিষয়।’
‘তাই যে করেই হোক, যেভাবেই হোক ডলারের বাজারকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তা নাহলে কিন্তু আমাদের সামনে বড় বিপদ আছে।’
পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলেছে ডলার। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে দর। বৃহস্পতিবার ১০৮ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি হয়েছে ব্যাংকে। খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে বিক্রি হয়েছে ১০৯ টাকার বেশি দামে। দিন যত যাচ্ছে, মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা ততই বাড়ছে। ডলার নিয়মিত দামি হচ্ছে, সেই সঙ্গে পড়ছে টাকার মান।
গত বছরের ২৮ জুলাই আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। সে সময় বাজার স্বাভাবিক ছিল। ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া এই রেটে নিজেদের মধ্যে ডলার কেনাবেচা করত। নগদ ডলার দুই-আড়াই টাকা বেশি দামে বিক্রি করত। খোলাবাজারেও প্রায় একই দামে ডলার কেনাবেচা হতো।
মহামারি করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় আমদানি বাড়তে থাকায় আগস্ট থেকে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে; দুর্বল হতে থাকে টাকা। এখনও সেটা অব্যাহত আছে। তার আগে এক বছরেরও বেশি সময় ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত এক বছরে আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে (ব্যাংক রেট) টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ। আর ব্যাংক ও কার্ব মার্কেটে বেড়েছে ৩০ শতাংশের মতো।
বাংলাদেশ ব্যাংক বুধবার ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা দরে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করেছে। এটাকেই এখন ইন্টারব্যাংক রেট বা ব্যাংক রেট বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে এর চেয়ে ৮/১০ টাকা বেশি দামে ডলার কেনাবেচা করছে।
ডলারের বিপরীতে টাকার বিশাল এই পতন দেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে- জানতে চাইলে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা আহসান মনসুর বলেন, ‘ডলারের এই অস্বাভাবিক উল্লম্ফন আমাদের অর্থনীতিকে প্রতি মুহূর্তে তছনছ করে দিচ্ছে। বড় ধরনের সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে আমাদের। আমদানি কমাতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। ডলার ছুটছে তো ছুটছেই।’
‘আমি হিসাব করে দেখেছি, আমাদের বিদেশি ঋণের বোঝা ইতোমধ্যে আড়াই লাখ কোটি টাকা বেড়ে গেছে। আমাদের মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ এখন ৯৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকারি ঋণ ৭ হাজার কোটি (৭০ বিলিয়ন) ডলার। আর বেসরকারি খাতের ঋণ ২ হাজার ৫০০ কোটি (২৫ বিলিয়ন) ডলার।
‘এক বছর আগে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। সে হিসাবে মোট ৯৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের টাকার অঙ্ক ছিল ৮ লাখ ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর বর্তমানে ব্যাংকে ডলারের রেট ১১০ টাকা দরে যদি আমি হিসাব করি তাহলে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
‘এই সহজ-সরল হিসাব কষেই আমি দেখতে পাচ্ছি, টাকার পতনে এক বছরে আমাদের বিদেশি ঋণের পরিমাণ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা বেড়েছে। এর মধ্যে সরকারি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। আর বেসরকারি খাতের ঋণ বেড়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
সম্পাদক ও প্রকাশকঃ বেলাল রিজভী
ই-মেইলঃ news.dailybibartan@gmail.com
ফোনঃ +8801611572441