সংরক্ষিত বনাঞ্চলে দখলদারদের রাজত্ব!
logo
ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সংরক্ষিত বনাঞ্চলে দখলদারদের রাজত্ব!

মাহমুদুল হাসান, তালতলী
মার্চ ১, ২০২৫ ১২:৩৬ অপরাহ্ণ
Link Copied!

বরগুনার তালতলী উপজেলার নলবুনিয়া বিটের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে টাকার বিনিময়ে অবৈধ জাল দিয়ে মাছ শিকার ও বনের গাছ কাটার অনুমতি দেওয়ার বিষয় সংক্রান্ত ঘুষের টাকার দর-কষাকষির একটি ভিডিও এসেছে সময়ের কন্ঠস্বর এর হাতে।

ওই ভিডিও’তে দেখা যায়, নলবুনিয়া বিটের অধীনস্থ শুভসন্ধ্যা সমুদ্র সৈকতে একটি চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ওই বিটের ওয়াচার হিসেবে কর্মরত জাহাঙ্গীর মিয়া। এসময় তিনি হায়দার মিয়া নামে এক জেলেকে বলেন, ওইদি (জাল) পাতা দেহি কার তা পাতা এহন কোলো কাটতে যামু কতা সোজা বাংলা। উত্তরে ওই জেলে বলেন, মোর জাল উঠাইয়া আনছি কার তা জানিনা। এসময় পাশেই চেয়ারে বসা দেখা যায় নলবুনিয়া বিটের বন প্রহরি জহিরুল’কে তিনি বলেন, ও (জেলে) কইতে আছে কি জানেন, আমাগো টাকা দেছে পনেরশো। জাহাঙ্গীর মিয়া বলেন, তুই (জেলে) কার কাছে টাকা দেছ? কিসের টাকা? উত্তরে ওই জেলে বলেন, জাল পাতি এই জন্য (টাকা) দিছি, প্রথমে দিছি ১ হাজার আলমগীর নেভোর হাত দিয়ে দেছে পরে উত্তম বাবু ফরেস্টার (নলবুনিয়া বিটের বাগান মালি) হে আনছে পাঁচশ এই হানিফ বিশ্বাস এর দোকানের এখান থেকে। জাহাঙ্গীর মিয়া ওই জেলেকে ধমক দিয়ে বলেন, কথা বুজতে পারছ, এহোন এই সিজনে (মৌসুম) টাকা দেবা ২ হাজার হইলে পাতপা (জাল) না হইলে বায় কতা হইলো এককালে কারছিট। এসময় পাশ থেকে এক ব্যাক্তি জিজ্ঞাসা করেন, এই ২ হাজার টাকা নেয় কে? তখন জাহাঙ্গীর মিয়া বলেন, কারা নেয়! নেয় না তো এগুলো ফাও ষতসব কথা বলে তিনি এড়িয়ে যান। জেলে হায়দার মিয়া নলবুনিয়া এলাকার আব্দুল হাই মিয়ার ছেলে। তাঁকে বন বিভাগের মামলার ফাঁসানোর ভয়ে এবিষয়ে কোন মন্তব্য করবেন না বলে জানান তিনি।

জানা যায়, উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের নলবুনিয়া বিট কার্যালয়টি দুর্নীতির আখড়ায় পরিনত হয়েছে। বন রক্ষা যদের দায়িত্ব, সেই বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বন রক্ষার নামে বনের গাছ বিক্রি থেকে বনের ভিতরে গবাদি পশু চরানোর অনুমতি সবকিছুতেই চলে তাদের ভয়াবহ বাণিজ্য। এভাবেই বাণিজ্যের মাধ্যেমে টাকা কামাতেই সময় পার করে এই বিটের কর্মকর্ত-কর্মচারীরা। এসব বাণিজ্যের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এই বিটের কর্মকর্তা শাওন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে জীববৈচিত্র, মৎস্য ও বনজ সম্পদ রক্ষায় যেখানে মাছ ধরার অনুমতি নেই সেখানেই খুব ছোট ফাঁসের নিষিদ্ধ জাল যা স্থানীয়ভাবে চরগড়া জাল বলা হয়। এ জাল দিয়ে মাছ শিকারের অনুমতি দিচ্ছে বনবিভাগ। এ জাল পাতার জন্য প্রয়োজন হয় শক্ত খুঁটির। এই খুঁটির জোগান দিতে শুভসন্ধ্যা সমুদ্র সৈকতের বনাঞ্চল থেকে শ্বাসমূলীয় বনের গাছ নিধন চলছে। এ কাজের অনুমতির জন্য প্রতি জেলেকে ২ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয় বন বিভাগকে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলে গবাদিপশু চরানোর অনুমতি নেই কিন্তু প্রতি গবাদিপশুর জন্য ৪’শ টাকা করে ঘুষ নিয়ে অনুমতি দেন বনবিভাগ। এছাড়াও এই বিট থেকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে গাছ কাটার অনুমতি দেন বনবিভাগ। এভাবেই গাছ কেটে সংরক্ষিত বনাঞ্চল বৃক্ষ শূন্য করছে বিট কর্মকর্তার নেতৃত্বাধীন একটি সংঘবদ্ধ চক্র। ওই চক্রের অন্যতম হলেন ওই বিটের ওয়াচার হিসেবে কর্মরত জাহাঙ্গীর মিয়া। তিনি বন ঘীরে এসব বাণিজ্যের টাকা আদায় করেন। জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে এ টাকার ভাগ নেন বিট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। জাহাঙ্গীর ওই বিটের ওয়াচার হিসেবে কর্মরত থাকলেও স্থানীয়দের কাছে তিনি বনবিভাগের বড় কর্তা হিসেবে পরিচিত। তার হাতে টাকা দিলেই বনের গাছ কাটা থেকে বনের ভিতরে গবাদি পশু চরানো সবকিছুর অনুমতি পাওয়া যায়। গত ১৫ ফেব্রুয়ারী পাচারের উদ্দ্যেশে বনের ভিতর থেকে মূল্যবান ১৫-২০ টি গাছ কেটে ফেলে জাহাঙ্গীর। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৫০ হাজার টাকা। গাছ কাটার বিষয়টি স্থানীয়দের নজরে আসলে তিনি বিষয়টি দামাচাপা দেওয়ার জন্য বনের জমি নিজের বলে দাবি করেন। পরে বন বিভাগ গাছ জব্দ করলেও এবিষয়ে কোন আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি তারা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পায়রা, বলেশ্বর ও বিষখালী নদীর বঙ্গোপসাগরের মোহনায় শুভসন্ধ্যা সমুদ্র সৈকতের চরে অবৈধ চরগড়া জাল পেতে মাছ ধরার জন্য সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে কম বয়সি গাছ কেটে খুঁটি হিসেবে পুতে রাখা দেখা যায়। সৈকত থেকে বনের ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখা যায় গরু ও ছাগলের পাল। এতে বনের ছোট ছোট চারা গাছ খেয়ে সাবাড় করে দিচ্ছে। একটু বনের ভিতরে ঢুকতেই দেখা যায় কাটা গাছের গোড়া। গাছ কেটে নেওয়ার এমন দৃশ্য চোখে পড়ে বনের বিভিন্ন জায়গায়। এভাবেই সংরক্ষিত বনাঞ্চল লুটপাট করে বানিজ্য করেন বন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জেলে জানান, নদীতে জাল পাততে হলে প্রতি বছর জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে বনবিভাগকে টাকা দিতে হয়। আগে প্রতি বছর ১ হাজার টাকা দিতাম। এখন প্রতি মৌসুমে ২ হাজার টাকা করে বছরে দুই মৌসুমে ৪ হাজার টাকা দিতে হয়। নদীতে আস্তে আস্তে মাছ কমলেও প্রতি বছর বাড়ে তাদের টাকার পরিমান। সময় মতো টাকা পরিশোধ না করলে জাহাঙ্গীর জাল কেটে দেন। তাই আমরা ভয়ে সময় মতো টাকা দিয়ে দেই।

ভিডিওতে টাকা চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর মিয়া বলেন, আমরা ওই জায়গায় গিয়ে দেখি জহিরুল (বন প্রহরি) ভাইর সাথে তর্কাতর্কি চলে হেইয়া দেখছি। কে কারে টাকা দেয়? ওটা একটা দাবার দিছি, চাপ সৃস্টি।

সংরক্ষিত বন থেকে তার গাছ কাটার বিষয়টি স্বিকার করে তিনি বলেন, ওটা আমার গাছ। আমি পটুয়াখালী থেকে অনুমদন করে আনছি। সময় পাইনা তাই গাছ নেই না।

ভিডিওর সত্যতা স্বীকার করেন নলবুনিয়া বিটের বাগান মালি উত্তম বাবু ও বন প্রহরি জহিরুল। তবে ঘুষের টাকার দর-কষাকষির বিষয় জানতে চাইলে কোন সদুত্তর দিতে পারেন নাই তারা।

এবিষয়ে নলবুনিয়া বিট কর্মকতা শাওন বলেন, বনাঞ্চল লুটপাট করে বানিজ্যর সাথে তিনি জড়িত না এবং এবিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। যদি এরকম কোন ঘটনা ঘটে যাচাই-বাচাই করে দেখবেন বলে জানান। ভিডিওর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভিডিওর বিষয়ে স্টাফরা আমার কাছে ক্ষমা চাইছে।

বন থেকে জাহাঙ্গীরের গাছ কাটার বিষয়ে তিনি বলেন, জাহাঙ্গীর ওই জমির মালিকানা দাবি করে গাছ কেটেছে। আমরা বন বিভাগের পক্ষ থেকে গাছ জব্দ করেছি। এবিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে।

তালতলী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মতিয়ার রহমান বলেন, এ বিষয়ে আমার জানা নেই। যদি অভিযোগ পাই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দৈনিক বিবর্তন এর প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।