আরও কঠিন হলো মধ্যপ্রাচ্যের সংকট
logo
ঢাকা, রবিবার, ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আরও কঠিন হলো মধ্যপ্রাচ্যের সংকট

বিবর্তন ডেস্ক
অক্টোবর ২০, ২০২৩ ১০:৩৩ অপরাহ্ণ
Link Copied!

গাজার আল-আহলি হাসপাতাল ধ্বংস হওয়ার আগেই ইসরায়েলের প্রতি জো বাইডেনের পূর্ণ সমর্থনের মাধ্যমে লাখো আরব ও ফিলিস্তিনিরা এটাই বিশ্বাস করে যে, আমেরিকা আসলে ইসরায়েলের শুধু সমর্থকের চেয়েও বেশি কিছু। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস গাজায় ইসরায়েল শিশুহত্যাসহ যা কিছু করছে, এসব কিছুর পেছনে আমেরিকাও দায়ী।

হামলার জন্য কে দায়ী তা নিয়ে তিক্ত মতবিরোধ অনেকের মনে কোনো পরিবর্তন আনবে না। গত ১২ দিনের যুদ্ধ ঘৃণা ও বিভেদকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

আল-আহলিতে হামলার যে অভিযোগ উঠেছে ইসরায়েল তা বিস্তারিত আকারে খণ্ডন করেছে। তারা এমন প্রমাণ হাজির করেছে, যেখানে বলা হচ্ছে- ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের ছোঁড়া একটি মিসাইল ইসরায়েলের বদলে ভুল করে তাদের নিজেদের সীমানায় পড়েছে।

ফিলিস্তিনিদের জন্য আল আহলিতে হামলার পার্থক্যটা নীতিগত নয় বরং মাত্রাগত। হামাসের আকস্মিক হামলার জবাবে ইসরায়েল প্রতিদিনই অসংখ্য ফিলিস্তিনিকে হত্যা করছে।

প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বাইডেনকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, হামাস প্রায় ১৪০০ ইসরায়েলিকে হত্যা করেছে, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক।

অন্যদিকে, ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের জীবনকে কতটা অসম্মান করে তার আরও একটি প্রমাণ হচ্ছে আল আহলি হাসপাতালে হামলা। ফিলিস্তিনিরা বিষয়টিকে এভাবেই দেখে।

হাসপাতালে হামলার খবরটি যখন প্রথম আসে তখন জো বাইডেনকে মধ্যপ্রাচ্যে উড়িয়ে নিয়ে আসার জন্য এয়ার ফোর্স ওয়ানের ইঞ্জিন গরম হচ্ছিল। কিন্তু সেটি উড়ার আগেই বাইডেনের সফরসূচি এলোমেলো হয়ে গেল।

ইসরায়েলের প্রতি প্রেসিডেন্ট বাইডেন গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই তেল আবিব গিয়ে নেতানিয়াহুর সাথে সাক্ষাৎ ও সমর্থন দেখানোটা তার কাছে স্বাভাবিকই মনে হয়েছে।

তবে তিনি আশা করছিলেন, তাড়াহুড়ো করে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে একটা সম্মেলন আয়োজন করে তার এই সফরটাকে কিছুটা ভারসাম্যপূর্ণ করার।

বাইডেনের পরিকল্পনা ছিল জর্ডানের রাজা, মিসরের প্রেসিডেন্ট এবং ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। কিন্তু আল-আহলি হাসপাতালে বিস্ফোরণের পর জর্ডান সেটা বাতিল করে দিয়েছে। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস দ্রুত ইসরায়েল-অধিকৃত পশ্চিম তীরে রামাল্লায় তার সদর দফতরে ফিরে যান।

সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর এবং জর্ডান প্রত্যেকে ইসরায়েলের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। ফলে এই সফরটি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জন্য আরও কঠিন হয়ে উঠে। একজন রাষ্ট্রপ্রধান সাধারণত তখনই কূটনৈতিক সফরে যান, যখন সব দরকষাকষি ও আলোচনার পর কোনো চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত থাকে।

সে হিসেবে তেল আবিবে আসা প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জন্য একরকম বাজি ছিল। তিনি চেয়েছিলেন, ইসরায়েলকে যুদ্ধে সহায়তা জারি রেখে গাজায় মানবিক বিপর্যয় কমানো – সম্ভবত নেতানিয়াহুর সঙ্গে যেটা ছিল অসম্ভব এক চেষ্টা।

তবে তাদের বৈঠক থেকে কিছু ফলাফল বেরিয়ে এসেছে। ইসরায়েল আরও বেশি সামরিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। যার বিনিময়ে তারা মিশর থেকে দক্ষিণ গাজায় খাবার, পানি ও ওষুধ সামগ্রী পরিবহনের অনুমতি দিয়েছে।

তবে হাসপাতালগুলোতে এই মুহূর্তে জেনারেটর চালানোর জন্য জরুরি তেলের প্রয়োজন। কিন্তু যখন এই চুক্তির ঘোষণা এসেছে তখন এ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি।

ইসরায়েলকে সহায়তা করা এবং তাদের যুদ্ধের নীতি সম্পর্কে মনে করিয়ে দেওয়া ছাড়াও বাইডেন আরেকটা বার্তা পরিষ্কার করে জানাতে চান যে, যুদ্ধটা যাতে কোনোভাবেই না ছড়ায়।

তিনি এরই মধ্যে দুটি বিমানবাহী রণতরী পূর্ব ভূমধ্যসাগরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে – ইরান এবং তার মিত্র লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীকে এটা দেখানো যে, তারা যদি কোনোভাবে এ যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে তাহলে যুক্তরাষ্ট্রকেও তাদের হিসেবে রাখতে হবে।

এ কারণে মধ্যপ্রাচ্যের ভেতরে ও বাইরের নেতারা হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে নতুন করে শুরু হওয়া এ যুদ্ধে মানিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে।

তার একটা কারণ হচ্ছে, তারা এখন অচেনা পরিবেশে এসে পড়েছে। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার আগ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য অনেকটা পরিচিত অবস্থাতেই ছিল। একটা স্থিতবস্থা বিরাজ করছিল। ফলে এই অঞ্চলের কোনো নেতা ও তাদের মিত্রদের এটি পছন্দ হবার কথা নয়, কারণ এতে যে স্থিতিশীলতা ভঙ্গ হবে তা তারা বুঝতে পারছিলেন।

হামাসের আকস্মিক হামলায় অন্যদের মতো ফিলিস্তিনিরাও সমান বিস্মিত হয়েছে।

নেতানিয়াহু হামাসের এমন হামলার পর ইসরায়েলে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের দ্বারা কঠোর সমালোচনার শিকার হন। ভয়াবহ সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার জন্য তাকেই দায়ী করা হয়। সাধারণ ইসরায়েলিদের ধারণা ছিল সরকার তাদের নিরাপদ রাখতে পারবে।

নেতানিয়াহুর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত তার আরেকটি ভুল ধারণা হলো যে, ফিলিস্তিনিদের বোধহয় স্বাধীনতা না দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে।

একই সাথে নেতানিয়াহু বিভাজন ও শাসনের চিরাচরিত কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে দুর্বল করতে চেয়েছিলেন, যারা হামাসের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী।

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বছরের পর বছর নিষ্ফল শান্তি আলোচনা চালিয়েছে এবং অনেক আগেই ইসরায়েলকে মেনে নিয়েছে তারা।

তবে আবারও আলোচনায় ফেরার জন্য ইসরায়েলকে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র, যার রাজধানী জেরুসালেম, সেটার জন্য ভূমি হস্তান্তরের উদ্যোগ নিতে হবে।

তবে বর্তমান চরম ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী সরকারের নেতা হিসেবে ক্ষমতায় থাকা নেতানিয়াহুর জন্য এখন সেই আলোচনার আর কোনো সুযোগই নেই। তার অতীত বলছে, তিনি কখনোই এ ধরনের ছাড় দিতে আগ্রহী ছিলেন না।

নেতানিয়াহু অথবা তার উত্তরসূরিকে এখন চিন্তাভাবনা বদলাতে হবে যদি তারা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আরও যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচাতে চায়।

যুক্তরাষ্ট্রের আরব মিত্রদের নেতারাও এটা ভালোভাবেই মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, ফিলিস্তিনিদের অগ্রাহ্য করা যাবে না।

জর্ডান ও মিসর বহু আগেই ইসরায়েলের সাথে শান্তি চুক্তি সম্পন্ন করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতও আব্রাহাম রেকর্ডের মাধ্যমে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে এনেছে।

66

জো বাইডেন নতুন যে মধ্যপ্রাচ্যের কথা বলছিলেন তা থেকে সবাই লাভের আশায় ছিল। এমন একটা কূটনৈতিক কৌশল অর্জন করা যাবে যার মাধ্যমে সৌদি আরব ও ইসরায়েল একে অন্যকে মেনে নেবে যার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা সহায়তার নিশ্চয়তা দেবে।

বাইডেনের তরফ থেকে মনে করা হচ্ছিল যে, তারা এ লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়া এখন আলোচনার বাইরে।

আরব রাজা, যুবরাজ ও প্রেসিডেন্টদের জন্য গাজায় যুদ্ধ এবং হাসপাতালে হামলা অনেকটা দুঃস্বপ্ন ফেরত আসার মতো।

২০১০ সালের শেষ দিকে তিউনিসিয়ার একজন হতাশ ও ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ী নিজের গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। এর মাধ্যমেই ২০১১ সালের আরব বসন্তের সূত্রপাত, যখন নেতারা ভয় পেয়েছিলেন যে, তারা সবকিছু হারাতে পারে – শুধু ক্ষমতা এবং সম্পদ নয়, এমনকি তাদের জীবনও।

যদি তিউনিশিয়ার একজন ক্ষুব্ধ মানুষের মৃত্যুর ঘটনা বিপ্লবের সূচনা করতে পারে তাহলে এই যে যুদ্ধ যেটাতে হাজারো ফিলিস্তিনি বেসামরিক মানুষদের হত্যা করছে, তার ফলাফল কী হবে?

দুই সপ্তাহের রক্তপাতে কিছু নিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে যে, মরুভূমির বালিতে নতুন কিছু সৃষ্টি হবে। নতুন অবস্থার উৎপত্তি হবে যুদ্ধ থেকেই।

হয়তো যে ধাক্কাটা এটা দিয়েছে তা শক্তিধর দেশগুলোকে নতুন করে ভাবাবে। যদি এটি আবারও পুরনো পদ্ধতিকেই ফেরত আনে, তাহলে ভবিষ্যতে কঠিন সময়ই অপেক্ষা করছে। -বিবিসি বাংলা

দৈনিক বিবর্তন এর প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।