উজানের ঢলে বাড়ছে পানি, বাড়ছে শঙ্কা
logo
ঢাকা, সোমবার, ২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উজানের ঢলে বাড়ছে পানি, বাড়ছে শঙ্কা

অনলাইন ডেস্ক
মে ২৪, ২০২২ ৯:২৬ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

উজান থেকে নেমে আসা ঢলে উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীর পানি বাড়ছে। যমুনা ও পুনর্ভবা নদীর পানি বেড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। দুই জেলায় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বিঘা জমির বোরো-ইরি ধান ছাড়াও বাদামসহ বিভিন্ন ফসল তলিয়ে গেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

দিকে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ও স্রোতের তীব্রতা বাড়ায় কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধাসহ কয়েকটি এলাকায় ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। বসতভিটা হারিয়ে অকূল পাথারে পড়েছে কয়েক শ পরিবার। নদীতে বিলীনের শঙ্কায় রয়েছে আরও অসংখ্য বাড়িঘর, গাছপালা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ কয়েক শ হেক্টর আবাদি জমি। স্থানীয়দের অভিযোগ, বারবার সতর্ক করার পরও এ ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা।

জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর: যমুনা নদীতে গত কয়েক দিন ধরে হুট করে পানি বাড়ায় সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলায় অন্তত আড়াই হাজার বিঘা জমির চিনাবাদাম ও পাকা-আধা পাকা ইরি-বোরো ধান তলিয়ে গেছে। ফসল হারিয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন আট শতাধিক কৃষক।

স্থানীয় সূত্র জানায়, গত এক সপ্তাহে উপজেলার বাঘুটিয়া, উমারপুর, সদিয়াচাঁদপুর, স্থলচর, ঘোরজান, খাষকাউলিয়া, খাষপুখুরিয়া ও ঘোরজান ইউনিয়নের বিভিন্ন চরের বাদাম, ইরি ও আউশ ধানের খেত ডুবে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন খাষপুখুরিয়া, বাঘুটিয়া ও উমারপুরের কৃষকেরা।

উমারপুর গ্রামের কৃষক আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমরা একই সাথে বাদাম আর আমন ধান চাষ করি, হঠাৎ পানি আসায় বাদাম তো গেলই, ধান হওয়ার সম্ভাবনাও নাই।’
চৌহালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জেরিন আহমেদ বলেন, হঠাৎ বন্যার পানি বেড়ে চিনাবাদাম ও ইরি ধানচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য কোনো বরাদ্দ এলে তাঁদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।

এদিকে উজানের ঢলে পুনর্ভবা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। সপ্তাহখানেক আগেই উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের বিল কুজন এলাকার তিন হাজার বিঘা জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় এবার একই ইউনিয়নের বিবিষন (লালমাটিয়া) এলাকায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বিলের সংযোগ সড়কে হিসেবে ব্যবহৃত বাঁধটি ভেঙে যাওয়ায় সিঙ্গাবাদ পাথার বিলে ধানবোঝাই অর্ধশতাধিক ট্রাক্টর আটকা পড়েছে। ধান রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন কৃষকেরা। কিন্তু শ্রমিকসংকট এবং অতিরিক্ত মজুরির কারণে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁদের। পরিস্থিতি সামাল দিতে দ্রুত বাঁধটি সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন কৃষকেরা। এদিকে পানি বাড়তে থাকায় চন্দের বিলও প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

রাধানগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান জানান, বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে। গোমস্তাপুর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান হাসানুজ্জামান নুহু জানান, উপজেলা সমন্বয় কমিটির সভায় বর্ষা মৌসুমে বিলাঞ্চলের এ দুরাবস্থার কথা তুলে ধরা হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আগামী বছর যাতে বাঁধটি মেরামতসহ কৃষকের অন্যান্য দাবির বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, এলজিইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি নজরে রেখেছেন।

এ দিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসমা খাতুন বলেন, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। সবার প্রচেষ্টায় বাঁধটি মেরামত করা হবে।

এদিকে গত কয়েক দিনের টানা প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এবারও গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় তীব্র নদীভাঙন শুরু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ভাঙন দেখা দিয়েছে উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নের কটিয়ারভিটা, ভুষিরভিটা, দাড়িয়ারভিটা ও এরেন্ডাবাড়ী ইউনিয়নের জিগাবাড়ী, সন্ন্যাসীর চর, আনন্দবাড়ী, চর চৌমহন, ধলী পাটাধোয়া গ্রামে। এসব এলাকায় এরই মধ্যে দুই শতাধিক পরিবার ভাঙনের শিকার হয়ে তাদের বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে উড়িয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ কাবিলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর-কালাসোনা সরকারি প্রাথমিক, দাড়িয়ারভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকার বহু ঘর-বাড়ি ও ফসলি জমি।

সরেজমিনে উড়িয়া ইউনিয়নের কটিয়ারভিটা গ্রামে দেখা যায়, এ এলাকায় ভাঙনের গতি বেড়ে গেছে। ভাঙনকবলিত এলাকার লোকজনের মধ্যে দুশ্চিন্তা রয়েছে। বাড়িঘর ভেঙে ও গাছপালা কেটে নিয়ে এলাকা ছাড়ছেন নদী পাড়ের মানুষ।

উড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা কামাল পাশা বলেন, ‘নদীভাঙন এ এলাকার মানুষের প্রধান সমস্যা। প্রতিবছর ভাঙনে অনেক পরিবার তাদের বসতভিটা ও ফসলি জমি হারিয়ে ফেলেন। তাই ভাঙন প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।’

গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভাগীয় উপ-প্রকৌশলী মজিবর রহমান বলেন, নদীভাঙন রোধে উড়িয়ার কটিয়ারভিটা থেকে ভূষিরভিটা পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ৬৫০ মিটার এলাকায় ৬৫ হাজার বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। প্রকল্প এলাকা ভাঙনমুক্ত হলেও আশপাশের কিছু এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ব্রহ্মপুত্রের আগ্রাসী আচরণে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়নেও ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। গত কয়েক দিনের ভাঙনে বিলীনের অপেক্ষায় বসতভিটাসহ ওই ইউনিয়নের একমাত্র মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দক্ষিণ খাওরিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ।

স্থানীয়রা জানায়, গত বছর তীব্র ভাঙনে ইউনিয়নের কয়েক শ পরিবার বাস্তুহারা হয়। ভাঙনে বিলীন হয় দক্ষিণ খাওরিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাংশ। কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার অনুরোধ করলে নামমাত্র কিছু জিও ব্যাগ ফেলা হলেও প্রতিষ্ঠানটি রক্ষায় স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে এ বছর আবারও ভাঙনের কবলে পড়েছে ইউনিয়নের একমাত্র স্কুল অ্যান্ড কলেজটি।

ব্রহ্মপুত্রের তীব্র ভাঙনে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির একটি ভবনের টিন ও অন্যান্য সরঞ্জাম সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ভাঙনে বিলীন হওয়ার অপেক্ষায় মূল ভবন।

কলেজের অধ্যক্ষ জহিরুল ইসলাম মন্ডল বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি নয়ারহাট ইউপির একমাত্র মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পার্শ্ববর্তী অষ্টমীরচর ইউপিসহ দুই ইউপির একমাত্র কলেজও এটি। ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বারবার অনুরোধ করেও কোনো কাজ হয়নি। আমরা এখন নীরব দর্শক। তিলে তিলে গড়া প্রতিষ্ঠানটি এখন বিলীনের অপেক্ষায়।’
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘ভবনটি রক্ষায় আমি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সাথে কথা বলে ব্যবস্থা নেবো।’

নয়ারহাট ইউপির চেয়ারম্যান আবু হানিফা বলেন, ‘প্রশাসনকে আমরা সব সময় জানাচ্ছি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ মনে করে চরের ভাঙন স্বাভাবিক ঘটনা। ফলে ভাঙন রোধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। প্রতিবছর ভাঙে কিন্তু যে সময় ভাঙন রোধে কাজ করা প্রয়োজন সে সময় কোনো কাজ করা হয় না। যেভাবে ভাঙন শুরু হয়েছে তাতে আগামী এক-দুই মাসের মধ্যে কয়েক শ হেক্টর আবাদি জমিসহ শতাধিক বসতভিটা বিলীন হয়ে যেতে পারে।’

দৈনিক বিবর্তন এর প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।