প্রতি চারজন মানুষের মধ্যে একজন চোখের কোনো না কোনো প্রকার অ্যালার্জি জনিত সমস্যায় ভুগে থাকে। এটি খুবই সাধারণ অসুখ, তবে ছোঁয়াচে নয়।
কোনো জিনিসের প্রতি শরীরের অতি সংবেদনশীলতা থাকলে ওই বস্তু বা জিনিস শরীরের সংস্পর্শে এলে অতি দ্রুত কিছু উপসর্গ তৈরি হয়। যেমন ত্বক লাল হয়ে যায়, চুলকায়, ফুলে যায়, পানি পড়ে ইত্যাদি। যখন অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী বস্তু চোখের সংস্পর্শে আসে তখন চোখেও একই প্রতিক্রিয়া হয়। একে চোখের অ্যালার্জি বা অ্যালার্জিক কনজাংটিভাইটিস বলা হয়। তবে চোখের অন্যান্য অসুখ আর চোখের অ্যালার্জি এক নয়।
অ্যালার্জি কেন হয়
যেসব পদার্থ অ্যালার্জি তৈরি করে, সেগুলোকে বলে অ্যালার্জেন। সেগুলো চোখের সংস্পর্শে গেলে তৈরি হয় চোখের অ্যালার্জি।
- অ্যালার্জি তৈরিকারী খাবার খেলে অ্যালার্জি হয়।
- চোখে কিছু প্রসাধনী ব্যবহারে অ্যালার্জি হতে পারে।
- ফুলের রেণু, ধুলাবালি, পোকামাকড়ের জন্যও অ্যালার্জি হতে পারে।
- ওষুধে ব্যবহৃত প্রিজারভেটিভ ও ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায়ও অ্যালার্জি হতে পারে।
চোখের যত অ্যালার্জি
চোখে সাধারণত ৬ ধরণের অ্যালার্জি হয়ে থাকে।
সিজনাল অ্যালার্জিক কনজাংটিভাইটিস
এটিতেই মানুষ আক্রান্ত হয় বেশি। বিশেষ বিশেষ ঋতুতে এর প্রকোপ বাড়ে। যেমন, শীতের শেষে। বাতাসে ভেসে বেড়ানো ফুলের রেণু, ধুলাবালি ইত্যাদি অ্যালার্জেন চোখ ও নাকের সংস্পর্শে আসার কারণে এটি
হতে পারে।
রোগের লক্ষণ
- চোখে চুলকানি
- চোখ লাল হওয়া
- চোখ ফুলে যাওয়া
- নাক দিয়ে সর্দি ঝরা
- হাঁচি-কাশি হওয়া
- নাক বন্ধ ভাব হওয়া
- জ্বর হওয়া।
পেরেনিয়াল অ্যালার্জিক কনজাংটিভাইটিস
সারা বছর ধরেই এ রোগটি কমবেশি হতে দেখা যায়। সাধারণত লেপ, তোশক, কাঁথা ইত্যাদি থেকে চোখের এই অ্যালার্জি হয়ে থাকে। লক্ষণ কমবেশি সিজনাল কনজাংটিভাইটিসের মতোই।
ভারনাল কেরাটো-কনজাংটিভাইটিস
শীতের শেষের দিকে, ফেব্রুয়ারি-মার্চে, রোগটি বেশি হয়। এতে সাধারণত ছোটরা বেশি আক্রান্ত হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমতে থাকে। তিনজন শতাংশ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এ রোগে যাঁরা আক্রান্ত হন, তাঁদের অনেকের আবার হাঁপানি, চর্মরোগ ইত্যাদি থাকে। কর্নিয়া ঘোলা হয়ে দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে।
রোগে লক্ষণ
- চোখে চুলকানি
- চোখ দিয়ে বেশি পানি ঝরা
- চোখের ভেতরে কিছু আটকে থাকার অনুভূতি
- আলোর দিকে তাকাতে অসুবিধা হওয়া
অ্যাটপিক কেরাটো-কনজাংটিভাইটিস
সাধারণত বয়স্ক মানুষ এতে বেশি আক্রান্ত হয়। আগে থেকেই যাঁদের ত্বকের প্রদাহ বা ডার্মাটাইটিস থাকে, তাঁদের রোগটি হওয়ার ঝুঁকি বেশি। সারা বছরই রোগটি হতে দেখা যায়।
রোগের লক্ষণ
- চোখে অতিমাত্রায় চুলকানি
- চোখ জ্বালাপোড়া করা
- লাল হয়ে যায়
- চোখের কোণে ময়লা জমা
- ঘুম থেকে ওঠার পর চোখ খুলতে অসুবিধা হওয়া।কন্ট্যাক্ট অ্যালার্জিক কনজাংটিভাইটিস সাধারণত যাঁরা চোখে কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করেন, এ রোগ তাঁদের বেশি হয়।
রোগের লক্ষণ
- চোখ লাল হওয়া
- প্রচণ্ড চুলকানি
- লেন্স পরলে অসুবিধাবোধ
- চোখ থেকে ঘন ঘন পানি ঝরা
- চোখে ময়লা জমা
জায়ান্ট প্যাপিলারি কনজাংটিভাইটিস
কন্ট্যাক্ট অ্যালার্জির একটি মারাত্মক ধরন এটি।
রোগের লক্ষণ
- চোখ চুলকানি
- চোখ ফুলে যাওয়া
- পানি ঝরা
- দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া
- চোখে কিছু আটকে থাকার অনুভূতি
- চোখ থেকে মিউকাস ঝরা
যাঁদের বেশি হয়
পারিবারিকভাবে যাঁদের হাঁপানি, চর্মরোগ, সর্দিজ্বর ইত্যাদি বেশি হওয়ার ইতিহাস থাকে, তাঁরা অন্যদের চেয়ে বেশি মাত্রায় চোখের অ্যালার্জিজনিত সমস্যায় ভোগেন। তবে চোখের কোনো কোনো অসুখও অনেক সময় অ্যালার্জি বলে মনে হতে পারে। এ ধরনের অসুখের মধ্যে আছে চোখ ওঠা, আঘাতজনিত চোখের প্রদাহ ইত্যাদি।
চিকিৎসা
চোখের অ্যালার্জিজনিত সমস্যায় চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।
এ জন্য–
- অ্যালার্জি উদ্রেককারী বস্তু থেকে দূরে থাকুন
- চোখে সানগ্লাস বা রোদচশমা ব্যবহার করুন
- কোনো কিছুতে অতি সংবেদনশীল হলে তার চিকিৎসা করান
স্বল্পমেয়াদি চিকিৎসা হিসেবে সাধারণত চোখের ড্রপ ও অ্যালার্জি প্রতিরোধী ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এতে ভালো না হলে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। কখনো কখনো চোখের কর্নিয়া ঠিক রাখতে চোখের কৃত্রিম পানি ড্রপ হিসেবে নিয়মিত দিতে হয়। তবে আগে থেকেই যাঁদের চোখের অসুখ,
যেমন গ্লকোমা, ছানি কিংবা রেটিনাইটিস আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে নাক বন্ধ ভাব দূর করার ওষুধ বা ডিকনজাস্ট্যান্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে
সতর্ক থাকতে হবে।
চোখের অ্যালার্জির পরিণতি
- বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সারা জীবন অ্যালার্জির সমস্যা কমবেশি থাকবে। তবে ভারনাল কেরাটো-কনজাংটিভাইটিসে শিশু বয়সে যাঁরা আক্রান্ত হন, বয়স বাড়লে তা সেরে যায়।
- চোখের কর্নিয়ায় ক্ষত হয়ে দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে।
- স্টেরয়েড ব্যবহারে চোখের অ্যালার্জি সেরে যেতে পারে। কিন্তু গ্লকোমা বা ছানির মতো চোখের অন্য অসুখ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
- যাঁদের কিছুদিন পরপরই অ্যালার্জি হয়, তাঁদের উচিত চোখের চিকিৎসকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা।
লেখক: সাবেক ফ্যাকাল্টি ও প্রশিক্ষক, চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং কনসালট্যান্ট, আঞ্জুমান ভিশন কেয়ার, চট্টগ্রাম