অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দেশের মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হতে যাচ্ছে আগামী ২৫ জুন। প্রমত্তা পদ্মার বুকে অথৈ জল। স্রোতের গর্জন আর ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়তেই নেমে আসে মৃদু অন্ধকার। অন্ধকার একটু গাঢ় হতেই একযোগে জ্বলে ওঠে পদ্মা সেতুর আলো। স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে সংযোজন করা বাতি জ্বলে উঠতেই বর্ণিল রেখার মতো পদ্মার পাড়ে যেন সৃষ্টি হয় ছায়াপথ। যে পথ স্বপ্ন দেখাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলবাসীর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির।
পদ্মার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের বৃদ্ধ, কিশোর, যুবক, যুবতীর এখন আলোচনা একটাই। হাটে-বাজারে, পাড়ায়, মহল্লায়, মাঠ-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে, স্কুলে, কলেজে, অফিস-আদালত থেকে শুরু করে, গ্রামীণ সড়কের পাশের চায়ের দোকানেও সকল আলোচনাকে ছাপিয়ে প্রাধান্য পাচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ স্বপ্নের পদ্মা সেতু। দিন যতোই ঘনিয়ে আসছে ততোই আবেগে, উচ্ছ্বাসে, উত্তেজনায় আনন্দে অবগাহন করছে পদ্মা নদীর এপাড়ের ২১ জেলার কোটি-কোটি মানুষ, যারা যুগের পর যুগ ধরে এই একটি সেতুর অভাবে সীমাহীন দূর্ভোগ সহ্য করে আসছেন নীরবে। এসব মানুষের মধ্যে আত্মপ্রত্যয় দৃঢ় ছিল যে একদিন না একদিন বঙ্গবন্ধু কন্যার হাত ধরেই উত্তাল পদ্মার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এমন একটি সেতু যেটা হবে আমাদের গর্বের ধন।
২৫ জুন যে মুহুর্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করবেন, সেই মুহুর্তটি আমাদের ইতিহাসের পাতায় আরেকটি গৌরবদীপ্ত স্থান পেয়ে যাবে।
পদ্মা সেতুকে ঘিরে বিশেষ করে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা, শিবচরের পদ্মাবেষ্টিত চরাঞ্চলের গ্রামগুলোর চেহারা পাল্টে গেছে। নতুন নতুন সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এর ফলে গড়ে উঠছে নতুন নতুন কমপক্ষে দেড় ডজন বাজার। পুরানো হাট-বাজারগুলোতে লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। ফলে জীবনযাত্রার মান বেড়েছে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের। পদ্মা সেতুকে ঘিরে এ অঞ্চলে পর্যায়ক্রমে গড়ে উঠবে নানা শিল্প প্রতিষ্ঠান, বাড়বে কর্মসংস্থান। কৃষি পণ্য নিয়ে যখন-তখন বিভিন্ন স্থানে সহজেই যেতে পারবেন কৃষকরা। এর ফলে উন্নত জীবনের হাতছানি দেখছেন পদ্মাপাড়ের মানুষরা।
পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ার ভোগান্তি কমাবে পদ্মা সেতু
যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকরা জানান, ঘনকুয়াশা, তীব্র স্রোত, নাব্য, ঘাট ও ফেরি সংকটসহ নানা কারণে বছরজুড়েই বাংলা বাজার- শিমুলিয়া ও পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌ-রুটে দুর্ভোগ ও ভোগান্তি লেগেই থাকে। ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবে যানবাহনের চাপ বাড়লে দুর্ভোগ পৌঁছে চরমে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, পদ্মা সেতু চালুর পর ঘাটের এ চিত্র আর নাও দেখা যেতে পারে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা অঞ্চলের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) শাহ মো. খালেদ নেওয়াজ জানান, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌ-রুটে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে সাত হাজার যানবাহন পারাপার হয়।
অবসান ঘটল ফেরির জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা
ফেরির অপেক্ষায় যাত্রীবাহী বা মালবাহী ট্রাক, রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সসহ সারি সারি গাড়ি। অপেক্ষা ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সবার একই অবস্থা। লঞ্চ-স্পিডবোটে পার হওয়ায় আবার বাড়তি ঝুঁকি, বাড়তি টাকা। ফেরির অপেক্ষায় সড়কেই হয়েছে মৃত্যু, সময় শেষ হয়ে গেছে পরীক্ষার্থীর, প্রসূতির সন্তান প্রসব হয়েছে সড়কেই- এটা দেখতে দেখতে মাদারীপুরবাসী অভ্যস্ত। এই সংকটের অবসান হতে যাচ্ছে ২৫ জুন। পরদিন ভোর থেকে চলবে যানবাহন। যাতায়াতে ৬-৭ ঘণ্টার পথ শেষ হবে এক ঘণ্টায়।
মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজল কৃষ্ণ দে সাংবাদিককে জানান, দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পদ্মাসেতু চালু হচ্ছে, এই খবরে আমরা খুশি। আমাদের এই খুশির সংবাদের মূল কারিগর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বরণ করতে ও পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে বর্ণাঢ্য করতে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি।
পরিবহন ব্যবসায় আধুনিকতার ছোঁয়া
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পরই পরিবহন ব্যবসায় আসবে আধুনিকতার ছোঁয়া। মাদারীপুর থেকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে নামবে প্রায় দেড় শতাধিক এসি ও নন এসি নতুন বাস। এমন পরিকল্পনা রয়েছে পরিবহন ব্যবসায়ীদের। ইতোমধ্যে প্রথম ধাপে অন্তত ১শ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে বলেও জানিয়েছেন পরিবহন ব্যবসায়ীরা। নতুন বাসের ফিটিং করতে ব্যস্ত সময় পারছেন মাদারীপুরের শ্রমিকরা। মাদারীপুর শহরের ১২টি কারখানায় চলছে নতুন বাসের ফিটিংস এবং রঙ-চঙের কাজ। সেতু উদ্বোধনের আগেই এই সব বাসগুলো প্রস্তুত হয়ে যাবে বলে আশা করছেন শ্রমিকরা।
পরিবহন ব্যবসায়ী ও বাস মালিক সমিতির নেতারা জানান, আধুনিক এবং মানসম্মত সেবা দিতে পারলে পরিবহন ব্যবসার মোড় ঘুরে যাবে।
সার্বিক পরিবহনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আতিকুর রহমান বাবু জানান, পদ্মা সেতু চালুর পর সড়কে কোনো ভোগান্তি থাকবে না। যাত্রীদের আরামদায়ক সেবা দিতে আমরা সড়কে আধুনিক এসি ও নন এসি বাস নামাতে যাচ্ছি। বেশকিছু বাস তৈরিও হয়েছে। এছাড়া অন্য বাসগুলোর শেষ মুহূর্তের কাজ চলছে।
মাদারীপুর জেলা বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান হাওলাদার জানান, জেলা বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতি শুধু বাংলাবাজার (কাঁঠালবাড়ি) ফেরিঘাট পর্যন্ত সেবা দিত। এখন পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে রাজধানী ঢাকাতেও যান চলাচলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে বাড়বে আয়ও।
যে সুফল পাবে মাদারীপুরবাসী
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর মাদারীপুর থেকে গুলিস্থান যেতে কত সময় লাগবে? ২ থেকে ৩ ঘন্টা। ভোরে রওনা দিয়ে অফিস আদালতের কাজ সেরে বাড়ি এসে রাতের খাবার খাওয়া যাবেতো? ঢাকা ও এর আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা বৃহস্পতিবার বিকেলে রওনা হয়ে রাত ৭টা-৮টার মধ্যে বাড়ি এসে মায়ের হাতের রান্না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারবে। অফিস আদালতে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা রবিবার ভোরে বাসে চেপে রাজধানীতে পৌঁছে সঠিক সময়ে কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত হতে আর বাঁধা থাকছে না।