`শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস` বাংলাদেশে পালিত একটি বিশেষ দিবস। প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর এই দিবসটি শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করা হয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল তার অন্যতম উদাহরণ হল বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ এই হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই পাকবাহিনীদের প্রধান শিকার ছিলেন এদেশের প্রতিথযশা শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, সাহিত্যিক,সাংবাদিকসহ প্রথম শ্রেণি’র মানুষগুলো। আর এই হত্যাকাÐ প্রকটরূপ ধারণ করে ১০-১৪ ডিসেম্বর এবং ১৪ ডিসেম্বরের সেই ভয়াবহতা সত্যিই মর্মান্তিক ছিল।
মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের অবদান ছিল অসামান্য। তাদের হাত ধরেই মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পরিচালিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের অসংখ্য লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী, চিকৎসক, শিক্ষক তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে অগ্রগামী করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের মূল নিয়ামক শক্তি ছিল জনগণ, তথাপি যুদ্ধের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে বুদ্ধীজীবীদের অবদান ছিল খুবই প্রশংসনীয়। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে খবর পাঠ, দেশাত্মবোধক গান, মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গান, কবিতা পাঠ, নাটক, কথিত ও অত্যাতন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলো বুদ্ধীজীবীরাই পরিচালনা করেন।
বুদ্ধীজীবীরা, রণক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের মানসিক, নৈতিক বল ধরে রাখতে সহায়তা, সাহস জোগানোর ক্ষেত্রে এবং জনগণকে শত্রæর বিরুদ্ধে দুর্দমনীয় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যা বিশ্বদরবারে প্রশংসা কুড়িয়েছে। এক কথায় যদি বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের দিক নির্দেশক কারা ছিল তবে বুদ্ধীজীবী হবে সেটার উত্তর। অন্যদিকে স্বাধীনতা আন্দোলনে রাজনৈতিক ব্যক্তবর্গের অবদান অতুলনীয়। রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধীজীবী ও অন্যান্য বাঙালিদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও জীবনের বিনিময়ে বাঙালি বিজয়ের দারপ্রান্তে এসে যখন উপস্থিত তখন পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি এদেশের শ্রেষ্ঠ মানুষদের নিঃশ্বেষ করে বাঙালি জাতিকে মেধাশূণ্য করার এক নীলনকশা আঁকেন।
সেই নকশানুযায়ী পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগিতায় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ধরে নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৯৭১ সালে বুদ্ধীজীবীদের উপর কি পরিমাণ অত্যাচার করা হয়েছিল সেটা বোঝা যায় তৎসময়ের উল্লেখযোগ্য পত্রিকা “দৈনিক আজাদ” পত্রিকার একটা বিবরণ দেখে। ১৯৭২ সালের ২রা জানুয়ারি উল্লেখিত পত্রিকায় ‘ কাঁটাসূরের বধ্যভূমি ‘ শীর্ষক এক মর্মস্পর্শী প্রতিবেদনে অধ্যাপিকা হামিদা রহমান বুদ্ধীজীবীদের নির্মম হত্যাকাÐের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘আর একটু দূরে যেতেই দেখতে পেলাম, একটি কঙ্কাল। শুধু পা দুটো আর বুকের পাঁজরটিতে তখনও অল্প মাংস আছে। বোধ হয় চিল-শকুন খেয়েছে। কিন্তু মাথার খুলিটিতে লম্বা লম্বা চুল।
চুলগুলো ধুলো-কাদায় মিলে গিয়ে নারীদেহের সাক্ষ্য বহন করছে। আর একটু এগিয়ে যেতেই বেশ কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখছে। আমি উপরে উঠতে একজন ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে আমাকে উপরে উঠিয়ে নিলেন। সামনে দেখি নিচু জলাভূমির ভেতর এক ভয়াবহ বীভৎস দমশ্য। সেখানে এক নয়, দুই নশ একেবারে বারো-তেরোজন সুস্থ মানুষ একের পর এক শুয়ে আছে। পাশে দুটো লাশ তার একটির হৃদপিÐ যেন ছিঁড়ে নিয়েছে…….। মাঠের পর মাঠ চলে গিয়েছে। প্রতিটি জলার পাশে হাজার হাজার মাটির ঢিবির মধ্যে কঙ্কাল সাক্ষ্য দিয়েছে কত লোককে যে মাঠে হত্যা করা হয়েছে।’
একই বছর ৮ই জানুয়ারি দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় মিরপুরের শিয়ালবাড়ী বদ্ধভূমি নিয়ে আনিসুর রহমান তার প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, ‘…..অথবা যদি না যেতাম সেই শিয়ালবাড়ীতে তাহলে দেখতে হতোনা ইতিহাসের বর্বরতম অধ্যায়কে। অনুসন্ধিৎসু হিসেবে যা দেখাও কোন মানুষের উচিত নয়। ওখানে না গেলে গায়ে ধরত না এমন দহনজ্বালা। সহ্য করতে হতো না ভয়, ক্রোধ, ঘৃণা মিশ্রিত এমন তীব্র অনুভূতি যে অনুভূতি বলে বুঝাবার নয়।’
বুদ্ধীজীবীদের নাম সরণ করতে গেলে প্রথমেই যে নামগুলো আসে তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নাম হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, দর্শনশাস্ত্রের গোবিন্দচন্দ্র দেব, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, আবদুল মুকতাদির, এস এম রাশিদুল হাসান, ড. এন এম ফয়জুল মাহী, ফজলুল রহমান খান, এ এন এম মুনিরুজ্জামান, ড. সিরাজুল হক খান, ড. শাহাদাত আলী, ড. এম এ খায়ের, এ আর খান নাদিম, সাদেক, শরাফত আলী, গিয়াস উদ্দীন আহমদ, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হবিবুর রহমান, ড.শ্রী সুখরঞ্জন সমাদ্দার, মীর আবদুল কাইয়ুম, চিকিৎসক ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ, ডা. হুমায়ুন কবীর, ডা. মুনসী আলী, ডা. নুরুল ইমাম, সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, সেলিনা পারভীন, আ ন ম গোলাম মস্তফা, গীতকার ও সুরকার আলতাফ মাহমুদ, রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, লেখক ও চলচিত্রকার জহির রায়হান, কবি মেহেরুন্নেসা, শিক্ষাবিদ ড. আবুল কালাম আজাদ। পাক-বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকর, আল-বদর, আলশামস কর্তৃক ১৯৭২ সাল থেকে সশ্রদ্ধ চিত্তে ১৪ ডিসম্বরকে শহীদ বুদ্ধীজীবী দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ১৪ ডিসেম্বরকে শহীদ বুদ্ধীজীবী দিবস ঘোষণা করেছিলেন। কারণ এই দিনেই সবথেকে বেশি অপহরণ এবং হত্যাকাÐ হয়েছিল যেটা সম্পূর্ণ বুদ্ধীজীবীরা ছিল।
২০শে ডিসেম্বর ১৯৭১ মুজিবনগর সরকারের এক মুখপাত্র জানান, ১৬ ডিসেম্বরে আত্মসমর্পণের পূর্বে পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ৩৬০ জন বুদ্ধীজীবীদের হত্যা করে। ১৯৭২ সালের সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ” বাংলাদেশ” নামক প্রামাণ্য চিত্রে বলা হয়, স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ৬৩৭ জন প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক-শিক্ষিকা, ২৭০ জন সেকেন্ডারি স্কুল শিক্ষক এবং ৫৯ জন কলেজ -শিক্ষককে এবং ৫৯ জন কলেজ -শিক্ষককে হত্যা করা হয়। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭২ একদল সাংবাদিক ঢাকার রায়ের বাজার এলাকায় পচনশীল একটি গণ কবরের সন্ধান লাভ করে। জাতির মেধাবী ব্যাক্তিবর্গদের দেহগুলো অত্যাচারের সুস্পষ্ট চিহ্ন নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। অন্যদিকে লালমাটিয়ায় শারীরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে একটি বন্দিশালা আবিষ্কার করা হয় যেটা আলবদরদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ এবং কামাল উদ্দীন, চিকিৎসক ফজলে রাব্বি, আব্দুল আলিম চৌধূরী এবং আবুল খায়ের পচনশীল লাশগুলে সেইদিনই পরিবার কর্তৃক সনাক্ত করা হয়।
সাংবাদিক সেলিনা হোসেনর লাশ শনাক্ত করা হয় তার পরের দিন। এছাড়াও কিছুদিনের মাঝে আরো বেশ কিছু বুদ্ধীজীবীদের লাশ চিহ্নিত করা হয়। লাশ সনাক্ত করার সময় শহীদ বুদ্ধীজীবীদের পরিবারের অনেকেই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন। এরকম আরো বদ্ধভূমি গুলো হলো মিরপুর, রায়ের বাজার এলাকা, তেঁজগাঁও এর কৃষি বর্ধিতকরণ বিভাগের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মহাখালীর টি.বি. হসপিটাল সহ আরো অনেক।
প্রতিবছর বুদ্ধীজীবী দিবস পালন বাঙালির মনে একটি নতুন প্রশ্ন রেখে যায়। বুদ্ধীজীবীরা যেমন তাদের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গিয়েছেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, সর্বপরি দেশের কল্যাণের জন্য তারা যেমন অকাতরে নিজের জীবন দিতে দ্বীধাবোধ করেননি, বীর সৈনিক হিসেবে কাজ করে গিয়েছেন, ঠিক তেমনি যেন আমরা দেশমাতৃকার প্রয়োজনে তাদের মতো করে তৈরি হই। আর এটাই হলো বুদ্ধীজীবী দিবসের প্রধান শিক্ষা।