কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলে ৫৮টি মা কাছিম থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে ৭ হাজার ৫২৮টি ডিম। বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) সন্ধ্যায় ২৭০টি কাছিমছানা জন্ম নেয়। জন্মের পরই সাগরের নোনাজলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এ কাছিমছানাগুলো সাগর-মহাসাগরে ১৯ বছর বিচরণ করবে।
এদিকে সামুদ্রিক কাছিম প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে জনসচেতনতার বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিন দেখা গেছে, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের পেঁচারদ্বীপ। এ সৈকতে মানুষ কিংবা কুকুরের বিচরণ অনেকটা কম। যার ফলে সৈকতের বালিয়াড়িতে বিচরণ করে লাল কাঁকড়া। আর সাগর থেকে রাতের আঁধারে ডিম পাড়তে ছুটে আসছে মা কাছিম। পেঁচারদ্বীপ সৈকতের বালিয়াড়িতে জন্ম নিয়েছে কাছিমের অগণিত ছানা। সমুদ্রের নোনাজলের ছোঁয়া পেয়েই যেন আনন্দে আত্মহারা ছানাগুলো।
মূলত রাতের আঁধারে বেলাভূমিতে উঠে আসে মা কাছিম। গোপনে ডিম পেড়ে লুকিয়ে রাখে বালির নিচে। এক-দুই দিন করে ৬০-৬৫ দিন পেরিয়ে ডিম ফুটে বেরিয়ে আসে খুদে কাছিমের ছানারা। মা কাছিম থেকে ডিম ফুটে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দেখভাল করে রাখে কাছিম সংরক্ষণকারীরা।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে ইউএসএআইডির অর্থায়নে নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্টের (নেকম) ইকো লাইফ প্রকল্পের কাছিম হ্যাচারিতে বাচ্চাগুলো ফোটানো হয়।
নেকম কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থাপক মো. আবদুল কাইয়ুম বলেন, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সোনাদিয়া, পেঁচার দ্বীপ, টেকনাফের শীলখালী ও শাহপরীর দ্বীপ এবং সেন্টমার্টিনে পাঁচটি কাছিমের হ্যাচারিতে এ বছর ৭ হাজার ৫২৮টি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে। সৈকতের ৫৮টি মা কাছিম ডিম পেড়েছে। আরও কয়েক দিন ডিম দিতে আসবে কচ্ছপ। এর মধ্যে পেঁচার দ্বীপে ১৮টি কচ্ছপ ২ হাজার ৩০টি ডিম, শীলখালীতে ৯টি মা কাছিম ১ হাজার ২৩৯টি ও শাহপরীর দ্বীপে ৩১টি কাছিম ৪ হাজার ২৫৯টি ডিম দিয়েছে।
নেকম-ইকো লাইফ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক ড. শফিকুর রহমান বলেন, গত তিন বছরের তুলনায় এ বছর কচ্ছপ ডিম বেশি দিয়েছে। ২০২২ সালে ৫৪টি স্পটে কাছিম ডিম দিয়েছিল ৫ হাজার ৭৬৩টি। এর আগের বছর ২০২১ সালে ডিম দেয় ৪ হাজার ৭১৩টি। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর হার ৮৬ শতাংশ। আর চলতি মৌসুমে এ পর্যন্ত সংগ্রহ করা হয়েছে কাছিমের ৭ হাজার ৫২৮টি ডিম।
এদিকে কাছিমের প্রজনন স্পটগুলোতে মানুষের আনাগোনা, স্থাপনা নির্মাণ, কুকুরের উপদ্রব কিংবা রাতে আলোক-সজ্জ্বা ও উচ্চ স্বরে গান-বাজনার কারণে সংকটাপন্ন সৈকতের উপকূল। যার কারণে কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলে কাছিমের প্রজনন স্থান নষ্ট হচ্ছে।
এ ব্যাপারে সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ও সমুদ্র বিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বলেন, অবমুক্ত এ কাছিমের ছানাগুলো সাগর-মহাসাগরে ১৯ বছর বিচরণ করবে। দীর্ঘ এই সময় পর আবারও স্ত্রী কচ্ছপগুলো এ সৈকতে ফিরবে। তবে পুরুষ কচ্ছপগুলো আর ফিরবে না। কিন্তু কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলে নানা কারণে কচ্ছপের প্রজনন স্থান নষ্ট হয়েছে। ফলে এখন এই উপকূলের চেয়ে ভারতের ওড়িশা উপকূলে কাছিম ডিম পাড়তে বেঁচে নিয়েছে। যা উদ্বেগজনক।
তবে এ বিষয়ে কারণ অনুসন্ধানে কাজ করছে সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা।
এদিকে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সারওয়ার আলম বলেন, সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে জনসচেতনতার বিকল্প নেই। সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীকেও একসঙ্গে কাজ করতে হবে। আর কাছিমের প্রজনন স্পটগুলোতে মানুষের আনাগোনা নিয়ন্ত্রণ ও কুকুর থেকে রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
নেকম-ইকো লাইফ প্রকল্পের উপ প্রকল্প পরিচালক ড. শফিকুর রহমান বলেন, কাছিম সংরক্ষণের জন্য কক্সবাজার পুরো সমুদ্র উপকূলে কাজ করছি। ৪০টি টিম রয়েছে, যারা এসব কাজে জড়িত। যার অধিকাংশ জেলে। যাদের নানাভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি কাছিম যে প্রকৃতির বন্ধু এবং ক্ষতি করা যাবে না এসব বুঝানো হচ্ছে। যার ফলে কাছিম সংরক্ষণে স্থানীয়রা এগিয়ে আসায় দিন দিন কাছিমের ডিম সংগ্রহ বাড়ছে।