থাকছে না খুলনার ইতিহাসের স্বাক্ষী ‘পিকচার প্যালেস হল’
logo
ঢাকা, সোমবার, ২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

থাকছে না খুলনার ইতিহাসের স্বাক্ষী ‘পিকচার প্যালেস হল’

নিজস্ব প্রতিবেদক
সেপ্টেম্বর ১০, ২০২২ ৮:১৬ পূর্বাহ্ণ
Link Copied!

পুরাতন স্থাপনাগুলোই একটি শহরের ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়। তেমনই এক ইতিহাস খুলনার পিকচার প্যালেস সিনেমা হল। ১৯৪২ সালে নির্মিত ‘নীলা হল’টি ৪৭-এর দেশভাগের পর ‘পিকচার প্যালেস’ নামকরণ করা হয়। এরপর এই হলকে কেন্দ্র করে পরিচিতি পায় আশপাশের এলাকা।

নানা কারণে গত এক দশক ধরে হলটি বন্ধ। তারপরও নগরের এই প্রাণকেন্দ্রটি এখনও পরিচিত ‘পিকচার প্যালেস মোড়’ নামে। বিভিন্ন সামাজিক, স্বেচ্ছাসেবী ও পেশাজীবী সংগঠন মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের জন্য এই মোড়টিকে বেছে নেয়।

আফসোসের কথা হচ্ছে, প্রায় ৮০ বছরের পুরানো সেই ‘পিকচার প্যালেস’ সিনেমা হলটি ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। গত বছরের শেষ দিকে হলটি কিনে নেন খুলনার নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির উপাচার্য ড. আবু ইউসুফ মোঃ আবদুল্লাহ এর মালিকানাধীন ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান। হল ভেঙ্গে সেখানে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করছেন তারা।

ইতোমধ্যে মূল হলটি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। বাকি অংশ ভাঙার বিষয়ে বাধ সেধেছে জেলা প্রশাসন। হলের জমিতে সৈয়দপুর ট্রাস্টের (হাজী মুহাম্মদ মহসিন) সম্পত্তি রয়েছে, এমন দাবিতে মামলা করেছে জেলা প্রশাসন। মালিকানা দ্বন্দ্বে অর্ধ ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে বহু ইতিহাসের এই স্বাক্ষী।

স্থানীয়রা জানান, মামলার কারণে গত ১০ মাস হল ভাঙার কাজ বন্ধ ছিলো। শুক্রবার ছুটির দিনে ৫/৬ জন শ্রমিক ফের বাকি অংশ ভাঙতে আসেন। তবে স্থানীয় দোকানদারদের প্রতিরোধের মুখে তারা চলে যান।

দেখা গেছে, হলের বাইরের দোকানগুলো এখনও আগের মতোই রয়েছে। ভেতরের অংশের মূল হলটি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। যার কারণে বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, হল ভাঙা হচ্ছে।

যেভাবে হলো পিকচার প্যালেস

খুলনার ইতিহাস গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চল্লিশের দশকে খুলনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন জমিদার শৈলেন চন্দ্র ঘোষ। তার মা একদিন ‘উল্লাসীনি’ সিনেমা হলে ছবি দেখতে গিয়েছিলেন। লাইনে দাড়িয়ে হলে প্রবেশ করতে তিনি অপমানিত বোধ করেন। বিষয়টি ছেলেকে জানানোর পর শৈলেন চন্দ্র ঘোষ ১৯৪২ সালে নিজেই একটি সিনেমা হল প্রতিষ্ঠা করেন। মায়ের নামানুসারে সিনেমা হলের নাম দেওয়া হয় ‘নীলা হল’। হলের দ্বিতল ভবনের প্রধান ফটকে নীল নিয়ন আলোয় লেখা ‘নীলা হল’ এখনও জ্বল জ্বল করে পুরাতন দর্শকদের মণে।

পিকচার প্যালেস হল

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর শৈলেন ঘোষরা স্বপরিবারে ভারতে চলে যান। তখন ভারত থেকে আসা পীর মোহাম্মদ নামের এক অবাঙালীর সঙ্গে তাদের জমির মালিকানা বিনিময় হয়। পরবর্তীতে পীর মোহাম্মদরা ওই হলের নামকরণ করেন ‘পিকচার প্যালেস’। ক্রমেই ওই হলের সামনের স্থানটি পিকচার প্যালেস মোড় নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এখন খুলনা নগরীর অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা পিকচার প্যালেস মোড়।

খুলনার প্রবীণ নাগরিকরা জানান, ষাটের দশকেই পিকচার প্যালেস সিনেমা হলটি আধুনিকায়ন করে তাতে এসি ও সিনেমাস্কোপ পর্দা লাগানো হয়। প্রায় প্রতি শোতেই থাকতো ‘হাউসফুল’। কিছুদিন পর শুক্র ও রোববার সকাল সাড়ে ১০ টায় যোগ হয় মর্নিং শো। মর্নিং শোর ছবিগুলো ছিল ইংলিশ। মর্নিং শোর ছবিগুলোতে হাউসফুল হতো না। কিন্তু তারপরও মালিক নিয়ম করে ইংলিশ ছবি চালাতেন। বাংলা, হিন্দি ও পাকিস্তানী ছবির ভিড়ে ওই ইংলিশ ছবিগুলো খুলনার মানুষের জন্য ছিল বাইরের পৃথিবীর একটা খোলা জানালা।

নতুন মালিকরা চান বহুতল ভবন

২০২১ সালের শেষ দিকে হলের কিছু জমি সরাসরি, কিছু জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য বিক্রি করেছেন পীর মোহাম্মদের পরিবারের সদস্যরা। প্রাসাদ নির্মাণ প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করবে। ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের মালিক ড. আবু ইউসুফ মোঃ আবদুল্লাহ খুলনার নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্মকর্তারা এটি দেখাশোনা করছেন। এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা রাজি হননি।

খুলনার ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ কমিটির সদস্য সচিব মহেন্দ্রনাথ সেন বলেন, একটি শহরের প্রাণ হচ্ছে তার ইতিহাস-ঐতিহ্য পুরাতন সব স্থাপনা। নগরীর ডাকবাংলো ও পিকচার প্যালেস হলকে কেন্দ্র করে ওই এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। কয়েক বছর আগে ডাকবাংলোটি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এখন ভাঙা হচ্ছে হল। দায়িত্বশীলদের উচিত পুরাতন এসব স্থাপনা সংরক্ষণে উদ্যোগী হওয়া।

দৈনিক বিবর্তন এর প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।