ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিরিয়েছেন দলকে, গড়েছেন রেকর্ড জুটি। সপ্তম উইকেটে বাংলাদেশের আগের রেকর্ড (১২৭) ভেঙে নতুন রেকর্ড (১৭৪) গড়লেন আফিফ হোসেন ও মেহেদী হাসান মিরাজ। তাদের ব্যাটে চেপে প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচে জয়ের হাসি হাসল টাইগাররা। তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে আফগানিস্তানকে ৬ উইকেটে হারাল বাংলাদেশ।
কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে এসে আলোচিত হয়েছিলেন মিরাজ। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের দল চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের সঙ্গে ঝামেলায় জড়ান তিনি। সেই চট্টগ্রামেই আবার আলোচনায় মিরাজ। আজ সেখানে আফিফের সঙ্গে রেকর্ড জুটি বেঁধে বাংলাদেশকে এনে দিলেন দারুণ এক জয়। আফিফ-মিরাজের যুগলবন্দীতে শুরুতেই ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলা বাংলাদেশ আফগানদের বিপক্ষে তুলে নিল অসাধারণ জয়।
তবে এর আগের গল্পটা ছিল ভয়ংকর। আফগানদের দেওয়া ২১৫ রান তাড়া করতে নেমে প্রথম ওভারে দুটি বাউন্ডারি হাঁকিয়ে দারুণ শুরুর ইঙ্গিন দেন তামিম। কিন্তু এরপরই হঠাৎ এক ঝড়ে লণ্ডভণ্ড বাংলাদেশের ব্যাটিং। সেই ধ্বংসযজ্ঞে নেতৃত্ব দেন বিপিএলে ঢাকার হয়ে খেলা আফগান পেসার ফজলে হক ফারুকি। ইনিংসের তৃতীয় এবং নিজের দ্বিতীয় ওভারেই এই পেসার জোড়া শিকারে ফেরান লিটন আর তামিমকে। ফারুকির মিডল স্টাম্পে থাকা বল ডিফেন্স করতে চেয়েছিলেন লিটন। ঠিক মতো পারেননি। ব্যাটের কানা ছুঁয়ে জমা পড়ে উইকেটরক্ষকের গ্লাভসে। লিটন ফেরেন ৮ বলে মাত্র ১ রান করে।
এক বল পর পা বাড়িয়ে খেলতে চেয়েছিলেন তামিম। ব্যাটে-বলে করতে পারেননি, লেগেছে প্যাডে। আম্পায়ার আউট না দিলেও রিভিউ নিয়ে সফল ফারুকি। ৮ বলে ৮ রান করে বিদায় নেন তামিম।
ইনিংসের পঞ্চম ওভারে আবার জোড়া আঘাত ফারুকির। এবার তার গতির কাছে পরাস্ত মুশফিকুর রহিম ও অভিষিক্ত ইয়াসির আলি রাব্বি। মিডল স্টাম্পে পড়ে প্রায় সোজা যাওয়া বলের লাইনে যেতে পারেননি মুশফিক। আরেকটু বেশি সুইং আশা করা ‘মিস্টার ডিপেন্ডডেবল’ এলবিডব্লিউ হওয়ার পর নেন রিভিউ। কাজ হয়নি তাতে। রিপ্লেতে দেখা গেছে বল লাগতে অফ-মিডল স্টাম্পে। এক বল পরেই ফারুকির বলের লাইন মিস করে বোল্ড হয়ে শূন্য রানে সাজঘরে ফিরে যান ইয়াসির রাব্বি। ১৮ রানে ৪ উইকেট পড়ে যায় বাংলাদেশের।
অষ্টম ওভারে বোলিংয়ে এসে সাকিব আল হাসানকে ফেরান তার বিপিএল সতীর্থ মুজিব উর রহমান। অফ স্টাম্পের বাইরের বল ব্যাটের কানায় লেগে স্টাম্পে আঘাত হানলে সাকিব আউট হন ১৫ বলে ১০ রানে।
এরপর একই পথে পা বাড়িয়ে সাজঘরে ফেরেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও। রশিদ খানের শর্ট বল জায়গায় দাঁড়িয়ে কাট করার চেষ্টা করেন মাহমুদউল্লাহ। ঠিক মতো পারেননি কাট করতে, ক্যাচ যায় স্লিপে। ১৭ বলে ৮ রান করে আউট হয়ে যান অভিজ্ঞ এই মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। মাত্র ৪৫ রানে প্রথম সারির ৬ ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে পড়ে বাংলাদেশ।
নিজেদের ইতিহাসে সর্বনিম্ন (৫৮) রানের মধ্যে গুটিয়ে যাওয়ার একটা শঙ্কা যখন তৈরি হয়, তখন থেকেই গল্পটা নিজেদের করে নেন মিরাজ আর আফিফ। দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ধীরে ধীরে দলকে ভেড়ান জয়ের নোঙরে। সেই ভীষণ চাপের সময় নেমে দুই তরুণ খেলেন ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস। দলকে লড়াইয়ে ফেরানোর পথে গড়েন সপ্তম উইকেটে বাংলাদেশের সেরা জুটি। ২০১৮ সালে মিরপুরে মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের সঙ্গে ইমরুল কায়েসের ১২৭ ছিল বাংলাদেশের পক্ষে সপ্তম উইকেটে আগের রেকর্ড জুটি।
দুজনের অবিচ্ছেদ্য ১৭৪ রানের জুটিতে ৪ উইকেট আর ৭ বল হাতে রেখে জয় পেয়ে যায় বাংলাদেশ। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রথম অর্ধশতকের স্বাদ পান আফিফ হোসেন। মিরাজ তুলে নেন ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় অর্ধশতক। শেষ পর্যন্ত ১১৫ বলে ১১ চার ও ১ ছয়ে আফিফ অপরাজিত থাকেন ৯৩ রানে। ৯ চারের সাহায্যে ১২০ বলে ৮১ রানে অপরাজিত থাকেন মিরাজ।
এই জয়ের ফলে আইসিসি সুপার লিগে বাংলাদেশের আরো ১০ পয়েন্ট যোগ হলো।
এর আগে টস হেরে আগে বোলিং করা বাংলাদেশ দলের বোলাররা ইনিংসজুড়ে ভালো বল করেন। আফগানদের পুরো ৫০ ওভার খেলতে না দিয়ে অলআউট করেন ২১৫ রানে।
ইনিংসের তৃতীয় ওভারে আফগান ওপেনার রহমানউল্লাহ গুরবাজকে ফিরিয়ে দেন মুস্তাফিজ। তার বল উড়িয়ে বাউন্ডারির বাইরে ফেলতে চাইলেও তাতে ব্যর্থ হন গুরবাজ, ফেরেন মিডঅনে ক্যাচ দিয়ে। দলীয় ১১ রানে প্রথম উইকেট হারানোর পর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে সফরকারী শিবির। ইব্রাহিম জাদরান আর রহমত শাহ দেখেশুনে খেলতে থাকেন।
তাদের ৪৫ রানের পার্টনারশিপ ভেঙে স্বাগতিকদের ব্রেক থ্রু এনে দেন শরিফুল ইসলাম। বাঁহাতি পেসারের বেরিয়ে যাওয়া বলে ড্রাইভ করার চেষ্টায় স্লিপে ক্যাচ দেন ইব্রাহিম। এরপর এক প্রান্ত আগলে রেখে রান তুলছিলেন রহমত। হাঁটছিলেন অর্ধশতকের পথে। কটবিহাইন্ড করে তাকে ফেরান তাসকিন।
এক স্পেলে টানা ১০ ওভারে রান আটকে রাখার কাজ করেন মেহেদী হাসান মিরাজ। প্রতিপক্ষের অফ স্পিনের দুর্বলতা বুঝতে পেরে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের হাতেও বল তুলে দেন অধিনায়ক তামিম। ইনিংসের ২৮তম ওভারে নিজের একমাত্র ওভারে আফগান অধিনায়ক হাশমতউল্লাহ শাহিদিকে আউট করেন মাহমুদউল্লাহ। ৪৩ বলে ২৮ রান করে আউট হন হাশমত।
১০২ রানে ৪ উইকেট হারানোর পর পঞ্চম উইকেটে নাজিবউল্লাহ জাদরান আর অভিজ্ঞ মোহাম্মদ নবি গড়েন ৬৩ রানের পার্টনারশিপ। তাদের এই জুটি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ালে বোলিংয়ে বৈচিত্র্য আনেন তামিম। মিরাজ, সাকিব, শরিফুল, মুস্তাফিজরা সফলতার দেখা পাচ্ছিলেন না। পরে তাসকিনকে আক্রমণে ফেরান তামিম। প্রতিপক্ষকে গতির আগুনে পুড়িয়ে অধিনায়কের আস্থার মান রাখেন এই পেসার। ২০ রান করা নবিকে ফিরিয়ে ভাঙেন ৬৩ রানের জুটি।
এরপর নাজিবউল্লাহ একপ্রান্ত ধরে খেলে নিজের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ১৩তম অর্ধশতক তুলে নেন। সাকিব ইনিংসের ৪৫তম ওভারে এসে জোড়া আঘাতে ফেরান গুলবাদিন নাইব আর রাশিদ খানকে।
আফগানদের শ্লথ হয়ে থাকা রানের গতি শেষদিকে ফেরান নাজিবউল্লাহ। ৮৪ বলে ৬৭ রান করেন তিনি। তার এই হাফ সেঞ্চুরির সুবাদেই শেষ ওভারে অলআউট হওয়ার আগে স্কোর বোর্ডে ২১৫ রানের পুঁজি পায় আফগানিস্তান।
বাংলাদেশের হয়ে মুস্তাফিজ ৩টি এবং শরিফুল, সাকিব আর তাসকিন ২টি করে উইকেট নেন।