পুরান ঢাকার প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী পোগোজ ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ। বিদ্যালয়টিতে গত বছর থেকে একাদশ শ্রেণির পাঠ শুরু হয়েছে। এমন একটি মুহূর্ত উদ্যাপনে কত বড় আয়োজনের পরিকল্পনাই না ছিল কর্তৃপক্ষের। অথচ কিছুই হয়নি। প্রথম বছরে ভর্তি হওয়া ২৬ জন শিক্ষার্থী কলেজজীবনের প্রথম বছর প্রায় পার করে ফেলেছে। অথচ এখনো পর্যন্ত তারা ঠিকমতো জানেই না কে তাদের শিক্ষক, সহপাঠীই বা কারা।
এই অবস্থা শুধু পোগোজে নয়, সারা দেশের প্রায় ১৭ লাখ শিক্ষার্থীর। করোনা মহামারির মধ্যে এসএসসি পাস করে গত আগস্ট–সেপ্টেম্বরে তারা ভর্তি হয়েছে কলেজে। অথচ এখনো পর্যন্ত একটি দিন তারা পা রাখতে পারেনি কলেজ ক্যাম্পাসে। দেখা পায়নি শিক্ষকদের, আড্ডা দিতে পারেনি সহপাঠীদের সঙ্গে। অথচ কত স্বপ্নই না থাকে প্রত্যেকের কলেজ জীবন নিয়ে।শিক্ষক
অনলাইনে কিছু কিছু ক্লাস হলেও তা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী সামনের বছরের এপ্রিলে এসব শিক্ষার্থীর এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা রয়েছে। ক্লাস–পরীক্ষা না হওয়ায় উচ্চশিক্ষার ভিত যে কলেজশিক্ষা, সেখানে থেকে যাচ্ছে ভয়ানক দুর্বলতা।
গাজীপুরের বেগম রাবেয়া আহমেদ উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে পোগোজ স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে বর্ষা নন্দী। আজকের পত্রিকাকে সে বলে, ‘কলেজে ক্লাস করা এবং নতুন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার যে সুন্দর অনুভূতি, তা থেকে আমরা পুরোপুরি বঞ্চিত হয়েছি। কলেজে যেতে পারলে শিক্ষকদের সঙ্গে নিজেদের ভাবনা আদান-প্রদানের একটা সুযোগ থাকত এবং সহপাঠীদের সঙ্গে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠত। অথচ এখনো শিক্ষকেরা আমাদের চেনেন না, আমরাও তাদের চিনি না।’ ঠিকমতো ক্লাস না করে আগামী বছর এইচএসসি পরীক্ষায় কীভাবে বসবে তা নিয়ে সে উদ্বিগ্ন।
পোগোজ স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. মনির হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রথমবারের মতো কলেজ পর্যায়ে ছেলেমেয়েরা ভর্তি হলো, অথচ তাদের সামনে বসিয়ে একটি ক্লাসও নিতে পারলাম না। এর চেয়ে আর বড় দুঃখ আর কী হতে পারে?’
লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির মানবিক শাখার শিক্ষার্থী শাহাদাত হোসেন হৃদয় বলেন, ‘আমাদের শাখায় চার শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। এত দিন পার হলেও ভালো করে কারও চেহারাও দেখা হয়নি। ফেসবুক লাইভে ক্লাস চলে। না চিনি শিক্ষকদের, না চিনি ক্লাসমেটদের। সবই কৃত্রিম কৃত্রিম লাগে। কোনো পরীক্ষা দেওয়ার অভিজ্ঞতা ছাড়া এইচএসসি পরীক্ষায় বসলে ওপরওয়ালাই জানে কী হবে।’
এই কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ফিরোজ আলমের মতে, শিক্ষার্থীরা যদি সরাসরি ক্লাস না পায়, তাহলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক বিঘ্ন হয়। তিনি বলেন, ‘সরাসরি ক্লাসে পাঠদানের বাইরেও আমরা অভিজ্ঞতা, পারিপার্শ্বিকতা ও নৈতিক বিষয়াবলি নিয়ে কথা বলে থাকি, যা শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে খুব কাজে লাগে।’
বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, করোনাকালে বিভিন্ন পর্যায়ে অনলাইন, বেতার, টেলিভিশনের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে দূরশিক্ষণের যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, তার আওতায় এসেছে মাত্র ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী।
এতে করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষণে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তারিক আহসান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এসব শিক্ষার্থী পরবর্তী সময়ে যখন উচ্চশিক্ষা ও পেশাগত জীবনে যাবে, তখন এই দুর্বলতাটা থেকে যাবে।’ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যে অচেনা থেকে যাচ্ছে, সেটাকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করে তা মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন দেশের মতো এলাকাভিত্তিক শিক্ষণ চক্র গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।