বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন কমছে, তখন দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে চাপের মুখে ঠেলে দিয়েছে সরকার। এর ফলে সব জিনিসের দাম বেড়ে যাবে; মূল্যস্ফীতির পারদ আরও চড়বে। জনদুর্ভোগ চরমে উঠবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ী নেতারা।
তারা বলছেন, দুই বছরের বেশি সময়ের করোনা মহামারির ধাক্কা কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ওলটপালট হয়ে যাওয়া বিশ্ব পরিস্থিতিতে এমনিতেই বাজারে সব কিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। এরপর এক লাফে জ্বালানি তেলের দাম এতোটা বৃদ্ধির ফলে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে; বেড়ে যাবে পরিবহন খরচসহ অন্য সব খরচ। সব মিলিয়ে জনদুর্ভোগ চরমে উঠবে বলে মনে করছেন তারা।
একসঙ্গে এতোটা দাম না বাড়িয়ে ধাপে ধাপে বাড়ানো উচিৎ ছিল মনে করছেন তারা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৫০ কোটি (৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পেতে আইএমএফ এর শর্ত পূরণ করতে সারের পর তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ডলারের বিপরীতে টাকার মান দীর্ঘদিন ধরে রেখে মুদ্রাবাজারে যে বিপদ ডেকে এনেছে সরকার, সেই একই ভুল জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রেও করল। এতদিন ধাপে ধাপে না বাড়িয়ে এক লাফে এতটা বৃদ্ধিতে মানুষের সত্যিই নাভিশ্বাস উঠবে। সব কিছুর দাম বেড়ে যাবে। পরিবহন খরচ বাড়বে। যার ফলে মূল্যস্ফীতি যেটা এখন সাড়ে ৭ শতাংশ, সেটা আরও বেড়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘আইএমএফ এর ঋণের প্রধান শর্তই ছিল সরকারের ভর্তুকি কমাতে হবে। সেই শর্ত মেনেই তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। তবে একসঙ্গে এতোটা বাড়ানো উচিৎ হয়নি।’
শুক্রবার রাতে দেশে চার ধরনের জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে লিটারে ৩৪ থেকে ৪৬ টাকা বাড়িয়েছে সরকার।
হুট করে এত বেশি দাম বাড়ানোয় অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে– এ প্রশ্নের জবাবে আহসান মনসুর বলেন, ‘আইএমএফ এর ঋণের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে, যে কোনো মুহূর্তে ঘোষণা আসতে পারে। ঋণের জন্য আইএমএফ এর সঙ্গে সরকারের কী চুক্তি হয়েছে, সেটা তো আমরা জানি না। তবে সারের পর তেলের দাম বাড়ানোয় এখন আমাদের বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না যে, ঋণ পেতেই আইএমএফ এর কথামতো তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘দাম কিছুটা বাড়ানো হবে, এই আশঙ্কা ছিল। তবে সেটা সহনীয় পর্যায়ে রাখা যেত। যতটা বাড়ানো হয়েছে, তা চিন্তার বাইরে।
‘তবে আমি একটু ভিন্ন কথাও বলবো। সরকার একটা সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। রাজনীতি, ভোটের কথা না ভেবে তেলের দাম বাড়িয়ে সরকার দীর্ঘদিনের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। এর ফলে সরকারের বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি কমবে; বাজেটের ওপর চাপ কমবে। সরকার এক ধরনের স্বস্তিতে থাকবে।’
শুক্রবার রাতে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, এখন থেকে ডিজেলের দাম হবে ১১৪ টাকা লিটার, যা এত দিন ৮০ টাকা ছিল। এ ক্ষেত্রে দাম বাড়ানো হয়েছে ৩৪ টাকা। কেরোসিনের দামও একই হারে বাড়ানো হয়েছে। নতুন দর ডিজেলের সমান, অর্থাৎ ১১৪ টাকা লিটার। সাধারণত, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম সমান হয়।
বাড়ানো হয়েছে পেট্রল ও অকটেনের দামও। পেট্রলের নতুন দাম ১৩০ টাকা, যা এত দিন ৮৬ টাকা ছিল। এ ক্ষেত্রে দাম বেড়েছে লিটারে ৪৪ টাকা। অকটেনের দাম বাড়ানো হয়েছে লিটারে ৪৬ টাকা। এত দিন অকটেন ৮৯ টাকা লিটার বিক্রি হতো। এখন তা ১৩৫ টাকায় বিক্রি হবে।
শুক্রবার রাত ১২টার পর থেকেই নতুন এই দাম কার্যকর হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনোই জ্বালানি তেলের দাম একসঙ্গে এতটা বাড়ানো হয়নি। সব মিলিয়ে জ্বালানি তেল খাতে সরকারের ভর্তুকি একবারে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার পদক্ষেপ এটি। সরকার অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চাপে পড়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করছে। আইএমএফ এর ঋণের শর্তের মধ্যে অন্যতম হলো জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার। জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সেই শর্ত পূরণ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সরকার এর আগে গত নভেম্বরে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়েছিল। তখন দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮০ টাকা লিটার। ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর বাসভাড়া বাড়ানো হয় প্রায় ২৭ শতাংশ, যা তেলের দাম বাড়ানোর হারের চেয়ে অনেক বেশি। একই ভাবে তখন লঞ্চভাড়া বাড়ানো হয় ৩৫ শতাংশ।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। বিবৃতিতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘জনবান্ধব আওয়ামী লীগ সরকার সব সময় আমজনতার স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়। যত দিন সম্ভব ছিল, তত দিন সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির চিন্তা করেনি। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটা নিরুপায় হয়েই দাম কিছুটা সমন্বয়ে যেতে হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে সরকার জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে দিয়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সে অনুযায়ী জ্বালানি তেলের দাম পুনর্বিবেচনা করা হবে।’
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে দেশে দাম কম থাকায় তেল পাচারের আশঙ্কার কথাও উল্লেখ করেছে। এতে বলা হয়েছে, ‘ভারতের কলকাতায় ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি বাংলাদেশি মুদ্রায় ১১৪ টাকা। পেট্রলের দাম ১৩০ টাকা। দেশে দাম কম থাকায় তেল পাচার হওয়ার আশঙ্কা থেকেও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি সময়ের দাবি।’
জ্বালানি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিপিসি গত ছয় মাসে (ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই) জ্বালানি তেল বিক্রি করে ৮ হাজার ১৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে।
সরকার এমন এক সময় দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়াল, যখন বিশ্ববাজারে চড়া দাম কমতে শুরু করেছে। ডিজেলের দাম বিশ্ববাজারে ব্যারেলে ১৭০ ডলার থেকে নেমে ১৩০ ডলার হয়েছে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম কমে এখন ৯০ ডলারে এসেছে। এই দর এ বছর ৭০ থেকে ৮০ ডলারে নামতে পারে বলে পূর্বাভাস রয়েছে।
এমন সময় হুট করে এত বেশি দাম বাড়ানোর চাপ দেশের মানুষ নিতে পারবে না পারবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘একসঙ্গে এতোটা বৃদ্ধি আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। সব পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। পরিবহন ভাড়া বাড়বে। ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে। শুধু তাই নয়, রপ্তানি খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রপ্তানি পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। একসঙ্গে এতোটা না বাড়িয়ে অল্প অল্প করে বাড়ানো উচিৎ ছিল।’
হুট করে এত বেশি দাম বাড়ানোর চাপ অর্থনীতি নিতে পারবে না বলে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম।
তিনি বলেন, ‘দাম কিছুটা বাড়ানো হবে, এই আশঙ্কা ছিল। তবে সেটা সহনীয় পর্যায়ে রাখা যেত। যতটা বাড়ানো হয়েছে, তা চিন্তার বাইরে।’