ফুড পয়জনিং বা খাদ্যে বিষক্রিয়া একটি পরিচিত পেটের সমস্যা। অসাবধানতাবশত কোনো কারণে আমাদের খাবারে জীবাণু আক্রমণ করলে, সেই খাবার খাওয়ার পরে যেই অসুস্থতা দেখা দেয় তাকেই বলে ফুড পয়জনিং৷ এটি সাধারণত খুব একটা মারাত্মক হয় না। সচরাচর এক সপ্তাহের মধ্যেই ভাল হয়ে যায়। শিশু অথবা বয়স্ক যেই এতে আক্রান্ত হোক না কেনো, ফুড পয়জনিং এর চিকিৎসা সাধারণত বাড়িতেই করা যায়।
ফুড পয়জনিং এর লক্ষণ
খাদ্যে বিষক্রিয়ার কিছু লক্ষণ হলো—
* বমি বমি ভাব বা বমি
* পাতলা পায়খানা / ডায়রিয়া
* পেট কামড়ানো
* শরীরের তাপমাত্রা ৩৮° সেলসিয়াস/১০০.৪° ফারেনহাইট বা তার বেশি হওয়া
* অসুস্থ বোধ করা। যেমন: ক্লান্তি, গায়ে ব্যথা অথবা গায়ে কাঁপুনি ওঠা
যে খাবারের কারণে খাদ্যে বিষক্রিয়া ঘটেছে, তা খাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই সাধারণত এসব লক্ষণগুলো দেখা দেয়। তবে এর ব্যতিক্রম ও ঘটতে পারে। যেমন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শুরু হয়ে যায়। আবার কিছু ক্ষেত্রে লক্ষণ প্রকাশ পেতে কয়েক সপ্তাহও লাগতে পারে।
ফুড পয়জনিং এ আক্রান্ত হওয়ার কারণ
যেকোনো জীবাণুযুক্ত খাবার খেলেই খাদ্যে বিষক্রিয়া হতে পারে। বিশেষত খাবারটি যদি—
1. যথেষ্ট তাপ দিয়ে রান্না বা গরম করা না হয়।
2. সঠিক উপায়ে সংরক্ষণ করা না হয়। যেমন: যে খাবারটি ঠান্ডা করে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন তা যদি ফ্রিজে না রাখা হয়।
3. দীর্ঘসময় ধরে অসংরক্ষিত বা খোলা অবস্থায় ফেলে রাখা হয়।
4. খাবার তৈরি ও পরিবেশনের সাথে জড়িত কেউ যদি অসুস্থ থাকে অথবা ঠিকমতো হাত না ধুয়ে তৈরি বা পরিবেশনে অংশগ্রহণ করে।
5. খাবারটি যদি বাসি, পঁচা বা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়।
ফুড পয়জনিং হলে করণীয়
খাদ্যে বিষক্রিয়ার চিকিৎসা সাধারণত ঘরে থেকে নিজে নিজেই করা যায়। এর জন্য সাধারণত ডাক্তার দেখানো অথবা হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না৷ খাদ্যে বিষক্রিয়ার লক্ষণগুলো এক সপ্তাহের মধ্যেই আপনাআপনি সেরে যায়। ডায়রিয়া সাধারণত ৩ দিনের মধ্যেই সেরে যায় বা কমে আসে।
ফুড পয়জনিং এর ঘরোয়া চিকিৎসা
ফুড পয়জনিং হলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপার টি খেয়াল রাখতে হয় তা হল পানিশূন্যতা প্রতিরোধ করা। যেহেতু পায়খানা বা বমির সাথে শরীর থেকে অনেকটা পানি চলে যায় তাই এ সময়ে প্রচুর পরিমাণে পানি ও তরলজাতীয় খাবার, শরবত, ফলের জুস খেতে হবে। প্রয়োজনে খাবার স্যালাইন পান করতে হবে।
কখন দ্রুত ডাক্তার দেখাতে হবে?
খাদ্যে বিষক্রিয়ার সাথে নিচের লক্ষণগুলো উপস্থিত থাকলে দেরি না করে দ্রুত ডাক্তার দেখাতে হবে—
* পায়খানার সাথে রক্ত গেলে
* অনেক বেশি জ্বর থাকলে (জিহ্বার নিচে থার্মোমিটার দিয়ে মেপে তাপমাত্রা ১০২° ফারেনহাইটের বেশি পেলে)
* খুব ঘন ঘন বমি হয়ে শরীর থেকে দ্রুত পানি হারাতে থাকলে
* পানিশূন্যতার লক্ষণগুলো দেখা দিলে। যেমন: প্রস্রাবের পরিমাণ খুব কমে যাওয়া বা একেবারেই বন্ধ হয়ে যাওয়া, মুখ ও গলা শুকিয়ে আসা, দাঁড়ালে মাথা ঘুরানো ইত্যাদি
* ৩ দিনের বেশি ডায়রিয়া থাকলে
ফুড পয়জনিং প্রতিরোধের ১০ টি কার্যকরী উপায়
খাদ্যে বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা এড়াতে কার্যকর এমন ১০টি উপায় এখানে আলোচনা করা হলো—
১. নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা: নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে। সাবান ও পানি দিয়ে পরিষ্কার ভাবে হাত ধুয়ে এরপর ঠিকমতো শুকিয়ে নিতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে হাত ধোয়ার কথা একেবারেই ভুলা যাবে না—
* খাবার তৈরি বা পরিবেশনের আগে
* খাবার খাওয়ার আগে
* কাঁচা খাবার ধরার পর। যেমন: কাঁচা মাংস, মাছ, ডিম বা শাকসবজি
* ডাস্টবিন বা ময়লার বালতি হাত দিয়ে ধরলে
* টয়লেট ব্যবহারের পরে
* হাত বা টিস্যু দিয়ে নাক ঝাড়ার পরে
* কুকুর, বিড়াল বা অন্যকোন পশুপাখি হাত দিয়ে ধরার পরে
২. রান্নার জায়গা ও বাসনকোসন সবসময় পরিষ্কার রাখা: কাটাবাছার জায়গা, রান্নার জায়গা, ছুরি, বটি ও রান্নার কাজে ব্যবহৃত বাসনকোসন সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে। খাবার তৈরি করার আগে ও পরে, বিশেষ করে যদি কাঁচা মাংস, মাছ, ডিম বা সবজির সংস্পর্শে আসে সেক্ষেত্রে এসব ভালোমতো পরিষ্কার করে নিতে হবে। পরিষ্কার করার জন্য সাবান ও গরম পানিই যথেষ্ট। এর জন্য জীবাণুনাশক স্প্রে ধরনের কিছু ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন নেই।
৩. বাসন মোছার ন্যাকড়া বা কাপড় নিয়মিত ধোয়া বা পরিষ্কার করা: বাসন মোছার কাজে ব্যবহৃত ন্যাকড়া, কাপড় ও ছোট তোয়ালেগুলো প্রতিদিনের কাজ শেষে ধুয়ে দিতে হবে এবং পুনরায় ব্যবহারের আগে ঠিকমতো শুকিয়ে নিতে হবে। কারণ ময়লা, ভেজা কাপড় জীবাণু ছড়ানোর আদর্শ স্থান।
৪. আলাদা আলাদা কাটিং বোর্ড ব্যবহার বা পৃথক স্থানে কাটার ব্যবস্থা করা: কাঁচা খাবার (যেমন: কাঁচা মাংস ও মাছ) কাটার জন্য আলাদা আলাদা কাটিং বোর্ড ব্যবহার করতে হবে। এর মাধ্যমে এক খাবারে উপস্থিত জীবাণু অন্যান্য খাবারে ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে। আলাদা আলাদা কাটিং বোর্ড ব্যবহার সম্ভব না হলে প্রতিবার ব্যবহারের পর কাটিং বোর্ড অথবা কাটাকুটির জায়গাটি পরিষ্কার করে নিতে হবে যাতে কোন জীবাণু থেকে না যায়।
৫. কাঁচা মাছ-মাংস আলাদাভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা: সালাদ, ফল, পাউরুটি ইত্যাদি যেসব খাবার রান্নার প্রয়োজন হয় না সেগুলো সবসময় এমনভাবে সংরক্ষণ করতে হবে যাতে কাঁচা খাবার (যেমন: কাঁচা মাংস-মাছ) এর সংস্পর্শে না আসে। কারণ এগুলো যেহেতু রান্না করতে হয় না, তাই কাঁচা মাছ-মাংস থেকে কোন ধরণের জীবাণু এতে প্রবেশ করলে তা সাধারণত আর মরবে না।
৬. কাঁচা মাছ-মাংস ফ্রিজের নিচের তাকে রাখা: কাঁচা মাছ-মাংস সবসময় ফ্রিজের নিচের তাকে রাখা ভালো যাতে এগুলো বাকি খাবারের সংস্পর্শে না আসে বা এই তাক থেকে রক্ত বা পানি কোন কিছু গড়িয়ে অন্যান্য খাবারের গায়ে না পড়ে।
৭. পর্যাপ্ত উত্তাপ দিয়ে ভালোমতো রান্না করা: কাঁচা মাছ মাংস, সসেজ, কাবাব এসব চুলায় বা উনুনে ততক্ষণ পর্যন্ত রান্না করতে হবে যতক্ষণ না পর্যন্ত ভাপ বেরুচ্ছে। সেই সাথে নিশ্চিত করতে হবে যে মাংস পুরোপুরি রান্না হয়েছে। ভেতরের অংশ যেন গোলাপি (অর্থাৎ, কাঁচা) না থেকে যায় তা খেয়াল রাখতে হবে। রান্নার আগে মাছ-মাংস ধোয়ার সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যাতে এসব থেকে পুরো রান্নাঘরে জীবাণু ছড়িয়ে না পড়ে।
কাঁচা মাংস ফ্রিজে রাখলে এতে উপস্থিত ক্যাম্পাইলোবাক্টার নামক ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ কিছুটা কমে কিন্তু সম্পূর্ণভাবে কমে না। মাংসে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি সম্পূর্ণভাবে দূর করার জন্য রান্নাই সবচেয়ে নিরাপদ উপায়।
৮. ফ্রিজের তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস এর নিচে রাখা: ফ্রিজের তাপমাত্রা সবসময় ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস এর নিচে রাখা উচিত। কারণ এই নিম্ন তাপমাত্রায় জীবাণু বাঁচতে বা সংখ্যাবৃদ্ধি করতে পারে না। সাধারণত অটোমেটিক ফ্রিজগুলোতে তাপমাত্রা এভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা থাকে৷
ফ্রিজে একসাথে অনেক কিছু রাখার ফলে যদি পুরো ফ্রিজ ভরে যায়, বাতাস চলাচলের মত জায়গা না থাকে তবে এর ফলে তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে ফ্রিজিং এ ব্যাঘাত ঘটতে পারে। তাই ফ্রিজে অতিরিক্ত জিনিস একসাথে রাখা পরিহার করতে হবে৷
এছাড়া প্রয়োজন ব্যতীত ফ্রিজের দরজা যেন খোলা রাখা না হয়—সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
৯. অতিরিক্ত খাবারটুকু যত দ্রুত সম্ভব ঠান্ডা করে ফ্রিজে রেখে দেওয়া: অনেক সময়ে বেশি পরিমাণে খাবার একসাথে রান্না করে কিছু পরিমাণ সাথে সাথে খাওয়া হয় আর বাকিটা পরের বেলায় খাওয়ার জন্য রেখে দেওয়া হয়। এমনক্ষেত্রে এই অতিরিক্ত খাবারটুকু রান্নার পর যত দ্রুত সম্ভব (সর্বোচ্চ ৯০ মিনিট বা দেড় ঘন্টার মধ্যে) ঠান্ডা করে ফ্রিজে রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
ফ্রিজে রাখা এসব খাবার দুইদিনের মধ্যেই খেয়ে ফেলা উচিত এবং বারবার গরম করা উচিত না।
১০. মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার না খাওয়া: যেকোনো খাবার, বিশেষ করে পাউরুটি, প্যাকেটজাত দুধ ইত্যাদি যেসব খাবারের গায়ে উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার তারিখ লেখা থাকে, তা খাওয়ার আগে অবশ্যই তারিখগুলো দেখে নিতে হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে এমন কোনো কিছু কোনো অবস্থাতেই খাওয়া উচিত নয়। মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে কিন্তু খাবারটি দেখে বা ঘ্রাণ নিয়ে মনে হচ্ছে যে এখনো নষ্ট হয়নি—এমনটা মনে হলেও খাবারটি খাওয়া যাবে না।
কারণ এই মেয়াদের তারিখ সাধারণত নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নির্ধারণ করা হয়৷ পরীক্ষায় দেখা হয় যে এই খাবারটিতে জীবাণু আক্রমণ করতে ঠিক কতদিন সময় লাগতে পারে। তাই দেখে বুঝা না গেলেও মেয়াদোত্তীর্ণ খাবারে প্রকৃতপক্ষে জীবাণু আক্রমণ ও বংশবৃদ্ধি করতে শুরু করে দেয়।
ফুড পয়জনিং থেকে দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফুড পয়জনিং বা খাদ্যে বিষক্রিয়া একটি মৃদু অসুখ হিসেবে দেখা দেয়, যা কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে খাদ্যে বিষক্রিয়ার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। আবার অনেকের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা দেখা দেয়—এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এভাবে খাবারের মাধ্যমে জীবাণু ছড়িয়ে যেসব দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা দেখা দিতে পারে সেগুলো হলো—
1. দীর্ঘমেয়াদি আর্থ্রাইটিস বা বাতের সমস্যা
2. মস্তিষ্ক ও স্নায়ু ড্যামেজ/ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া
3. কিডনি ফেইলিউর ইত্যাদি