গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
logo
ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা

স্বাস্থ ডেস্ক
ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৪ ১০:৪৭ অপরাহ্ণ
Link Copied!

মা হতে চলেছেন, এজন্য আপনাকে অভিনন্দন! অনাগত সন্তান নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে মনে অনেক প্রশ্নও আসছে। তার মধ্যে একটি বিষয় সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তা হলো: আমার কী খাওয়া উচিত?

জীবনের সব পর্যায়েই স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গর্ভাবস্থায় এটা বিশেষভাবে জরুরি। সুষম খাবার আপনার সন্তানের বেড়ে ওঠা, তার বিকশিত হওয়া এবং সঠিক ওজন বজায় রাখতে সহায়তা করবে।

পরিবারের নতুন সদস্যের কল্যাণের জন্য কীভাবে আপনার খাবার তালিকায় পরিবর্তন আনবেন, তা জানতে আমাদের টিপসগুলো দেখুন।

গর্ভধারণকালে সুষম খাবারের তালিকা কীভাবে অনুসরণ করব?

একটি পুষ্টিকর খাবার তালিকা তখনই নিশ্চিত হয় যখন মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় সবগুলো খাদ্য উপাদানযুক্ত স্বাস্থ্যকর খাবার প্রতিদিনের খাবার তালিকায় থাকে।

ফলমূল: টাটকা, হিমায়িত ও শুকনো সব ফলই ভালো। খাবারের সময় আপনার প্লেটের অর্ধেক থাকা উচিত ফলমূল ও সবজি।
শাকসবজি: টাটকা, ক্যানে সংরক্ষণ করা, হিমায়িত বা শুকিয়ে সংরক্ষণ করা শাকসবজি- এগুলোর যে কোনোটি আপনি খেতে পারেন। সালাদের জন্য পাতাওয়ালা গাঢ় সবুজ শাকসবজি পুষ্টিকর। খাবারের সময় আপনার প্লেটের অর্ধেক থাকবে ফলমূল ও সবজি।
গ্রেইনস বা শস্য: আপনাকে খাবারের প্লেটে যে সব শস্য দেওয়া হবে, তার অর্ধেকটা ‘হোল গ্রেইন’ হতে হবে। হোল গ্রেইন হলো সেই সব খাবার যেগুলো প্রক্রিয়াজাত নয় এবং খাদ্যশস্যের পুরোটা থেকে আসা যেমন- ওটস, বার্লি, কুইনোয়া (কাওনের চাল), ব্রাউন রাইস (ঢেঁকিছাঁটা চাল) ও লাল আটা।
আমিষ: প্রতিদিন খাদ্যতালিকায় বিভিন্ন ধরনের আমিষযুক্ত খাবার রাখা গুরুত্বপূর্ণ। মাংস, পোল্ট্রি, শিম, মটরশুঁটি, ডিম, বাদাম ও বীজ জাতীয় খাবার- এগুলোর সবই আমিষসৃমদ্ধ খাবার।
ডেইরি: ডেইরি পণ্য বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই দেখে নিতে হবে সেগুলো যেন পাস্তুরিত হয়। দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য যেমন পনির, দই এগুলো ভালো খাবার।
তেল ও ফ্যাট (স্নেহ): স্নেহজাতীয় খাবারের ক্ষেত্রে প্রাণিজ ফ্যাট খাওয়াটা সীমিত করতে হবে। স্বাস্থ্যকর ফ্যাট অন্যান্য খাবারে পাওয়া যায় যেমন, কিছু মাছ, অ্যাভোকোডো ও বাদাম। খাবারে তেল আসে মূলত উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে (যেমন অলিভ ওয়েল ও ক্যানোলা ওয়েল)।

গর্ভাবস্থায় কোন কোন ভিটামিন ও খনিজ দরকার?

আপনার গর্ভধারণের শুরু থেকেই যেসব ভিটামিন ও খনিজ খাদ্য উপাদান প্রয়োজন সেগুলো তুলে ধরা হল :

ক্যালসিয়াম: আপনার সন্তানের দাঁত ও হাড় গঠনের জন্য ক্যালসিয়াম গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য প্রতিদিন ১ হাজার মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম গ্রহণ করতে হবে। দই, দুধ, পনির, পাতাযুক্ত গাঢ় সবুজ শাকসবজি ক্যালসিয়ামের ভালো উৎস।
আয়রন: প্রতিদিন ২৭ মিলিগ্রাম আয়রন গ্রহণের চেষ্টা করুন। আয়রন আপনার শরীরের লোহিত রক্ত কণিকাকে গর্ভে বাড়তে থাকা সন্তানকে অক্সিজেন সরবরাহে সহায়তা করবে। আপনি এটা পাবেন চর্বিহীন মাংস (রেড মিট), পোল্ট্রি, মটরশুঁটি ও শিমে।
আয়োডিন: আপনার সন্তানের মস্তিষ্কের যথাযথ বিকাশের জন্য প্রতিদিন ২২০ মাইক্রোগ্রাম আয়োডিন প্রয়োজন। আপনি আয়োডিন পাবেন ডেইরি পণ্য, সামুদ্রিক খাবার, মাংস ও ডিমে।
কোলিন: আপনার গর্ভের ভ্রুণের মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ড বিকাশে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান কোলিন। গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন আপনাকে এটা ৪৫০ মিলিগ্রাম করে গ্রহণ করতে হবে। এর জন্য দুধ, ডিম, বাদাম ও সয়া পণ্য খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে।
ভিটামিন ‘এ’: গাজর, মিষ্টি আলু এবং সবুজ পাতাওয়ালা শাকসবজি- এগুলোর সবকিছুতেই ভিটামিন ‘এ’ থাকে। ভিটামিন ‘এ’ আপনার সন্তানের হাড়ের বেড়ে ওঠা, দৃষ্টিশক্তি তৈরি ও ত্বকের বিকাশের জন্য প্রয়োজন। প্রতিদিন আপনাকে ৭৭০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ‘এ’ গ্রহণ করতে হবে।
ভিটামিন ‘সি’: গর্ভের সন্তানের মাড়ি, দাঁত ও হাড়ের বিকাশের জন্য প্রতিদিন আপনার ৮৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’ গ্রহণ করতে হবে। লেবু, কমলা, জাম্বুরার মতো বিভিন্ন সাইট্রাস ফল, ব্রোকলি, টমেটো ও স্ট্রবেরিতে ভিটামিন ‘সি’ থাকে।
ভিটামিন ‘ডি’: সূর্যের আলো, ফোরটিফাইড মিল্ক (এক্সট্রা ভিটামিন ও খনিজ যুক্ত দুধ), স্যামন ও সার্ডিনের মতো চর্বিসমৃদ্ধ মাছ- এগুলো আপনাকে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ৬০০ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিট ভিটামিন ‘ডি’ পেতে সহায়তা করবে। ভিটামিন ‘ডি’ আপনার শিশুর হাড় ও দাঁত গঠন এবং ভালো দৃষ্টিশক্তি ও ত্বকের বিকাশে সহায়তা করবে।
ভিটামিন ‘বি৬’: ভিটামিন ‘বি৬’ আপনার শিশুর লোহিত রক্ত কণিকা তৈরিতে সহায়তা করবে। প্রতিদিন আপনাকে ১.৯ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘বি৬’ গ্রহণ করতে হবে। গরুর মাংস, শূকরের মাংস, হোল গ্রেইন সিরিল ও কলা ভিটামিন ‘বি৬’ এর ভালো উৎস।
ভিটামিন ‘বি১২’: আপনার গর্ভের সন্তানের স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ এবং লোহিত রক্ত কণিকা তৈরিতে ভিটামিন ‘বি১২’ গুরুত্বপূর্ণ। মাছ, মাংস, পোল্ট্রি ও দুধ ভিটামিন ‘বি১২’ এর উৎস। প্রতিদিন আপনাকে ২.৬ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ‘বি১২’ গ্রহণ করতে হবে।
ফলিক এসিড: গর্ভবতী মায়েদের জন্য ফলিক এসিড বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই বি ভিটামিন শিশুর মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের জন্মগত ত্রুটি এড়াতে বিশেষ ভূমিকা রাখে এবং এটা ভ্রুণ ও প্ল্যাসেন্টার বৃদ্ধি ও বিকাশে সহায়তা করে। বাদাম, গাঢ় সবুজ পাতাওয়ালা শাকসবজি, শিম ও কমলা লেবুর রস প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ৬০০ মাইক্রোগ্রাম ফলিক এসিড পেতে সহায়তা করবে। যদিও এই পরিমাণ ফলিক এসিডের চাহিদা পূরণের জন্য শুধু খাবার যথেষ্ট নয়।

যথেষ্ট পরিমাণে ফলিক এসিড প্রাপ্তি কীভাবে নিশ্চিত করা যায়?

শুধু খাবার থেকে দৈনিক ৬০০ মাইক্রোগ্রাম ফলিক এসিড পাওয়াটা কঠিন হওয়ায় আপনি প্রতিদিন  সম্পূরক হিসেবে অন্তত ৪০০ মাইক্রোগ্রাম ফলিক এসিড সেবন করতে পারেন। তাতে আপনার প্রয়োজনটা পূরণ হবে। আপনি সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করার সময় থেকেই বা গর্ভধারণ নিশ্চিত হলেই এটা নেওয়া শুরু করতে পারেন। আপনার জন্য কোন সম্পূরকটি উপযুক্ত, সেটা বোঝার জন্য আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন।

 

গর্ভাবস্থায় কোন কোন খাবার এড়িয়ে চলা উচিত?

গর্ভবতী মায়েদের নির্দিষ্ট কিছু খাবার থেকে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আর তা গর্ভধারণ সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি করতে পারে। গর্ভধারণকালে আপনাকে যেসব খাবার এড়িয়ে চলতে হবে:

কাঁচা, পাস্তুরায়ন ছাড়া দুধ এবং ওই ধরনের দুধ থেকে তৈরি কোমল পনির। এগুলোতে লিসটেরিয়া নামের এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে, যা লিসটেরিওসিস নামের এক ধরনের রোগ তৈরি করতে পারে।

মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার। কারণ সেগুলোতে ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে।

কাঁচা ও পুরোপুরি রান্না না হওয়া মাংসজাত পণ্য যেমন সসেজ ও কোল্ড কাট। এগুলোতে টোকসোপ্ল্যাজমা গনডির মতো পরজীবী এবং সালমোনিলা ও লিসটেরিয়ার মতো ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে।

কাঁচা মাছ ও সিফুড। কারণ এগুলোতে উচ্চমাত্রায় ব্যাকটেরিয়া ও পরজীবী থাকতে পারে।

কিছু মাছে উচ্চ মাত্রায় পারদ (মার্কারি) থাকে এবং এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। বেশির ভাগ শিকারি মাছ যেমন হাঙ্গর, সোর্ড ফিশ, মার্লিন ও কিং ম্যাককেরেলে মার্কারি বেশি থাকে।

স্মোকড কিন্তু রান্না না করা মাছ যেমন, স্মোকড স্যালমন।

রান্না না করা অঙ্কুরিত বীজ, খাদ্যশস্য ও শিম। কাঁচা মূলা, শিম ও আলফালফার বীজ এবং রেডি-টু-ইট সালাদ এসব খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ এগুলোতে লিসটেরিয়া, সালমোনিলা ও ই. কোলির মতো ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে।

কাঁচা বা কম সিদ্ধ ডিম। এতে সালমোনিলা ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে।

যকৃত (লিভার) ও অন্যান্য অঙ্গের মাংস। যকৃতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকলেও এটা গর্ভধারিণী নারীদের খেতে বলা হয় না। কারণ এতে উচ্চমাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ থাকে এবং এই মাংসে বিষক্রিয়ার ঝুঁকি থাকে।

 

গর্ভবতী মার জন্য কীভাবে নিরাপদে খাবার প্রস্তুত করা যায়?

খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।

ব্যবহারের পর সব পাত্র ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।

মাংস পুরোপুরি রান্না করতে হবে।

রান্না না করা শাকসবজি, সালাদের সবজি ও ফলমূল খুব সতর্কতার সঙ্গে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।

যথাযথ তাপমাত্রায় খাবার সংরক্ষণ করতে হবে।

রান্নার পরপরই খাবার খেয়ে নিতে হবে।

 

গর্ভাবস্থায় কতটা বেশি খাওয়া দরকার?

প্রথম তিন মাসে আপনার কোনো বাড়তি খাবারের দরকার নেই। দ্বিতীয় তিন মাসে প্রতিদিন আপনার ৩৪০ ক্যালোরি বাড়তি দরকার হবে। আর শেষ তিন মাসে আপনার প্রতিদিন অতিরিক্ত ৪৫০ ক্যালোরি দরকার হবে। এই বাড়তি শক্তির জন্য হাতের কাছে স্বাস্থ্যকর হালকা খাবার যেমন বাদাম, দই ও তরতাজা ফলমূল রাখবেন। এ বিষয়ে উপযুক্ত পরিকল্পনা পেতে আপনার স্বাস্থ্য সেবাদাতার সঙ্গে কথা বলুন।

 

গর্ভধারণকালে কি ভেজিটেরিয়ান বা ভিগান ডায়েট মেনে চলা উচিত?

আপনি যদি ভেজিটেরিয়ান বা ভিগান ডায়েট অনুসরণ করেন তাহলে আপনাকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, আপনি যথেষ্ট পরিমাণে আয়রন, জিঙ্ক, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ‘বি১২’ ও ভিটামিন ‘ডি’ গ্রহণ করছেন। এ বিষয়ে সমাধান পেতে আপনার চিকিৎসক বা রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ান বা পুষ্টিবিদের সঙ্গে কথা বলুন।

দৈনিক বিবর্তন এর প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।